রোহিঙ্গা বিষয়ক নবনিযুক্ত উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান চলমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ না নেওয়ার সমালোচনা করে বলেছেন, সমস্যা সমাধানে এখন পর্যন্ত কোনো বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বুধবার দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বাসস’কে বলেন, ‘দীর্ঘ দিনের এই সঙ্কটটি মোকাবিলায় আমরা যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। ফলে বিশ্বব্যাপী বিষয়টির ওপর নজর কমে গেছে।’ ড. খলিলুর রহমান সমস্যাটিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুনরুজ্জীবিত করার উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এটাই হবে তার শীর্ষ অগ্রাধিকার। তিনি সংকটের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনায় গতি পুনরুদ্ধারের প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, তার তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হলো- রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশে ও আন্তর্জাতিক ফোরামে যাতে প্রাধান্য পায়, তা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতায় চীনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনাকালে, ড. রহমান মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উদ্ভুত রাজনৈতিক দৃশ্যপটের কথা স্বীকার করে বলেন, সেখানে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। তিনি মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে, সেটাকে বাস্তবতায় নিয়েই আমাদের সামনে এগুতে হবে। তিনি সতর্কতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে বলেন, কোনও তাড়াহুড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ঢাকাকে পরিস্থিতিটি যত্ন সহকারে মূল্যায়ন করা উচিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল অংশিজনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।’
ড. রহমান বলেন, বাংলাদেশ ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক দমন-পীড়নের পর থেকে কক্সবাজারে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এখানকার মানবিক সংকট অত্যন্ত নাজুক হলেও বিশ্বের অন্যত্র চলমান সংঘাতের কারণে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ এখন সবগুলো অঞ্চলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, ‘রাখাইনের সংকটই আজকের বিশ্বের একমাত্র প্রধান সমস্যা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ চলছে এবং আমাদের আন্তর্জাতিক মনোযোগ ও সমর্থনের জন্য প্রতিযোগিতা করতে হবে। তা সত্ত্বেও কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাসকারী দশ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষকে সামনে রেখে সংকটের মানবিক দিকটিকে সামনে রাখার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
উদ্ভুত পরিস্থিতি একটি সতর্ক ও সমন্বিত সাড়া পাওয়ার দাবি রাখে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকার প্রয়োজন পশ্চিমা জোটের অব্যাহত সমর্থন, কারণ তারা বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তায় প্রধান অবদানকারী। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার : রোহিঙ্গারা মূলত রাখাইনের বাসিন্দা, তারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের অবশ্যই তাদের দেশে ফিরে যেতে হবে। এর বিকল্প কোন সমাধান নেই।’
২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের নির্বাসন শুরু হওয়ার পর থেকে, মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে শরণার্থীদের মধ্যে আস্থার অভাব ও নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের চুক্তি সত্ত্বেও প্রত্যাবাসনের আগের প্রচেষ্টা দুবার ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্যস্থতায় চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি দেশটি জাতিসংঘের প্রস্তাব ও মিয়ানমারের পদক্ষেপের সমালোচনামূলক বক্তব্যেরও বিরোধিতা করছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তার পশ্চিমা অংশীদারদের বিরূপও করতে পারছে না, যা বাংলাদেশের অবস্থানকে জটিল করে তুলেছে। রোহিঙ্গা সংকট এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মানবিক সমস্যাগুলির মধ্যে একটি, যার কোনো সুস্পষ্ট সমাধান নেই।
ড. রহমানের নিয়োগ এমন এক সময়ে এসেছে, যখন এ সংকট সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও আন্তর্জাতিক চাপ নতুন করে এখানে আলোকপাত করছে।
এদিকে, বুধবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে (ইউএনজিএ) রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে একটি সময়সীমাবদ্ধ পরিকল্পনা প্রস্তাব পেশ করার জন্য ২০২৫ সালে সংশ্লিষ্ট সকল অংশিজনকে নিয়ে উচ্চ-পর্যায়ের একটি জাতিসংঘ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে ৭৯তম ইউএনজিএ’র সপ্তাহব্যাপী উচ্চ-পর্যায়ের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।