জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের সময় আহত ব্যক্তিদের প্রতি চারজনের একজন তীব্র মাত্রার বিষণ্নতায় ভুগছেন। অঙ্গহানি, চিকিৎসার অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব, সামাজিক নিরাপত্তা, বঞ্চনা ও মৃত্যুজনিত শোকের মতো অভিজ্ঞতা এই মানসিক রোগের কারণ।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য জানান মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা। বৈঠকটির আয়োজন করে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি)।
তীব্র বিষাদগ্রস্ত বা বিষণ্ন হলে বেশির ভাগ সময় একজন মানুষের মন খারাপ থাকে, কোনো কিছুতে আনন্দ থাকে না, কাজে তারা উদ্দীপনা পায় না। তাদের কাছে বর্তমান গ্লানিময় মনে হয়, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, আর ভবিষ্যৎ মনে হয় অন্ধকার। এ ছাড়া ঘুম কমে যায়, খাওয়ার রুচি কমে যায়, অতি তীব্র মাত্রায় গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। বৈঠকে গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের নিয়ে করা দুটি গবেষণা জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়।
একটি করেছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, অন্যটি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মানসিক রোগ বিভাগ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণা জরিপ পরিচালনাকারী দলের সদস্য কমিউনিটি ও সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ জানান, বিষাদ বা বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ—এই তিনটি বিষয়ের ওপর গবেষণাটি চালানো হয়। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, আহত ব্যক্তিদের ২৫.৫ শতাংশ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে; ১০.৯ শতাংশ মৃদু বা লঘু, ২১.৮ শতাংশ মাঝারি, ১৪.৫ শতাংশ গুরুতর বা তীব্র এবং ২৭.৩ শতাংশ চরমভাবে বিষাদগ্রস্ত। অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন তীব্র বিষাদগ্রস্ত।
তিনি জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ৫৫ জনের ওপর জরিপটি চালানো হয়েছে। আহত এই ব্যক্তিদের বয়স ১৪ থেকে ৫০ বছর। এর মধ্যে অর্ধেকের বয়স ২২ বছরের মধ্যে। জরিপে অংশ নেওয়া আহত ৫৫ জনের মধ্যে ৩৮ শতাংশ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। তাদের ৬২ শতাংশ অবিবাহিত।
আহত এই ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ ছাত্র এবং ২২ শতাংশ শ্রমিক।
বিএসএমএমইউর মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামসুল আহসান মাকসুদ বলেন, আহতদের ৬৫ শতাংশের ট্রমা-পরবর্তী পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেসে ডিস-অর্ডার দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ তারা বারবার সহিংসতার স্মৃতিতে আতঙ্কিত বোধ করেন। মনে করেন, তার জীবনে আবার সেই ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
বিএসএমএমইউর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের একদল চিকিৎসক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুলির আঘাত নিয়ে চিকিৎসা নেওয়া ৩১ জন রোগীর ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন।
মানসিক এমন অসুস্থতায় কাউন্সেলিংয়ের সুপারিশ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চোখের সামনে সহপাঠীদের ওপর গুলি ছোড়ার ঘটনা, রক্তে ভিজে যাওয়ার মতো ঘটনা দেখেছে মানুষ। এমন আক্রমণ ও আগ্রাসনের সময় যত মানুষ শারীরিকভাবে আহত হয়, মানসিকভাবে আহত হয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। শুধু আহতরাই যে এই সমস্যায় ভুগছেন, তা নয়। আন্দোলনে সহিংস ঘটনা যারা দেখেছেন, তাদের মধ্যেও এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক নাহিদা বুশরা বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত এবং বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের পাশাপাশি শহীদ ব্যক্তিদের পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) আহ্বায়ক ও বিএপির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের (বিএপি) আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মোত্তালিবের সভাপতিত্বে বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন বিএপির সদস্যসচিব অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন। অনুষ্ঠানে কি নোট প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মো রাহেনুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. মো. তৈয়বুর রহমান রয়েল।
বৈঠকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিরসনে সচেতনতা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ভুল ধারণা বেড়ে গেছে। অনেকে এটাকে পাগলামি বলে থাকেন। এটা এখনো কুসংস্কার হয়ে আছে। এই সমস্যা নিরসনে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।