হঠাৎ করেই আলোচনায় জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র। আগামীকাল বিকাল ৩টায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এ ঘোষণাপত্রটি উপস্থাপন করা হবে। কী আছে এ ঘোষণাপত্রে, কী হবে গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ- এ নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এদিকে শহীদের রক্তে লিখিত সংবিধান বাতিলের চেষ্টা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি সূত্রে জানা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দিতেই ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে আয়োজকদের পক্ষ থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সব দল-মতের মানুষকে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ ১৫৮ সমন্বয়ক শপথ নেবেন। গতকাল রাজধানীর বাংলামোটরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে কথা বলেন প্ল্যাটফরমটির নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক ও সাবেক সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ।
সারজিস আলম বলেন, ঘোষণাপত্রটি বিগত যেসব সিস্টেম মানুষ গ্রহণ করেনি এবং নতুন যে সিস্টেম চালু হবে তার পার্থক্য হিসেবে বাংলাদেশের একটি দলিল হয়ে থাকবে। নতুন যারা দেশ পরিচালনায় আসবেন তাদের জন্য এ ঘোষণাপত্র একটি নির্দেশক হিসেবে থাকবে। এটি বাংলাদেশের সব মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভুলেশন ৫ আগস্টে হওয়া উচিত ছিল। এটি না হওয়ার কারণে ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিগুলো মিডিয়ায়, বুদ্ধিজীবী পাড়ায়, সব জায়গায় আমরা যাদের উৎখাত করেছি, বিদেশে বসে তারা ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। ২ হাজার শহীদ এবং ২০ হাজারের বেশি আহতের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তারা গণ অভ্যুত্থানের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। গণ অভ্যুত্থানকে ঘিরে মানুষের যে আকাক্সক্ষা সৃষ্টি হয়েছে তার একটি দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ৩১ ডিসেম্বর জাতির সামনে মুজিববাদী ’৭২-এর সংবিধানের কবর রচিত হবে।
আবদুল হান্নান মাসউদ বলেন, শহীদ পরিবারের লোকজন ছাড়াও সব রাজনৈতিক দল ও গণ অভ্যুত্থানের পক্ষের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে জড়ো হবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা জানান, খুনি হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে করা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহলে পতিত স্বৈরাচার আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছেন। সুতরাং এ আন্দোলনকে সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা দিতে ঘোষণাপত্র প্রয়োজন, যাতে পতিত স্বৈরাচার ’২৪ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ষড়যন্ত্র করার সুযোগ না পায়। রাজনৈতিক পালাবদলে ’২৪- কে অস্বীকার করে বিপ্লবীদের হয়রানি যাতে না করতে পারে সেজন্যও ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা জরুরি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির একাধিক শীর্ষনেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির ১৯৪৭ সাল, এরপর ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণ অভ্যুত্থান, চব্বিশের গণ অভ্যুত্থান প্রভৃতি বিষয়সহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সব আন্দোলন সংগ্রাম এতে স্থান পাবে।
মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন বিজয়ের পর নতুন রাষ্ট্রে দেখা যায়নি। বাকশালের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষাকে শেখ মুজিবুর রহমান ভূলুণ্ঠিত করেছেন। এ ছাড়া ২০০৯ সালের পর শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্য দিয়ে নব্য বাকশাল কায়েম হয়েছে। তারপর কোন প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে তরুণদের হাত ধরে চব্বিশের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন বিলোপ ঘটেছে সেটিও উল্লেখ করা হবে ঘোষণাপত্রে। এর পাশাপাশি জুলাই প্রোক্লেমেশনে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র রেফারেন্স হিসেবে যুক্ত করা হবে। একাত্তরের মূল চেতনা ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ এ ঘোষণাপত্রে স্থান পাবে। এগুলোর পাশাপাশি নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র মূলনীতি হিসেবে যুক্ত হবে।
প্রসঙ্গত, জাতীয় নাগরিক কমিটি সংবিধান সংস্কার কমিশনে দেওয়া প্রস্তাবে উল্লেখ করেছিল- মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রকে প্রথম রিপাবলিকের এবং জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র জারি করে দ্বিতীয় রিপাবলিকের প্রস্তাবনা হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ ঘোষণাপত্রের সব আয়োজন করা হচ্ছে। তাদের সহযোগিতা করবে জাতীয় নাগরিক কমিটি।