কারাগার নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল প্রবল- কিন্তু আসামি হিসেবে ওখানে যেতে হবে এমন দুঃস্বপ্ন কোনো দিন মনের মধ্যে ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং তাঁর দোসর সালমান এফ রহমানের ঐকান্তিক চেষ্টায় আমার কারা গমন যখন অনিবার্য হয়ে উঠল তখন আমার সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা ছিল। প্রথমটি হলো, শেখ হাসিনার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসমেত কান্নাকাটি করে তাঁর অনুকম্পা প্রার্থনা করা নতুবা প্রাণপণ চেষ্টা করে, গা-ঢাকা দিয়ে, পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। শৈশব থেকেই আমার মধ্যে অদ্ভুত কয়েকটি দোষ বিষবৃক্ষের মতো মন-মস্তিষ্ক, আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বেড়ে উঠেছে। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা- মুখের ওপর উচিত কথা বলে দেওয়া অথবা ঘৃণিত ব্যক্তির কাছে যত স্বার্থই থাকুক না কেন তার ছায়াটি পর্যন্ত পরিহার করা।
আমার আরেকটি বদগুণ হলো, শতভাগ নিশ্চিত না হলে আমি কারও কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা ঝুলাতে পারি না। উল্টো কেউ যদি আমার সামনে মিথ্যা বলে বা অহেতুক বাহাদুরি দেখায়, সে ক্ষেত্রে আমার চোখমুখে এমন একটি অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নজর এড়ায় না। আমার এসব বদগুণ এবং বদ খাসলতের কারণে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহলে আমি একজন বেয়াদব, বেয়াড়া অতি পণ্ডিত প্রকৃতির অর্বাচীন বালকরূপে পরিচিত হয়ে গেলাম। তারা সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপর্যুপরি নালিশ জানাতে লাগলেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী লক্ষ করলেন যে অন্য সব তরুণ সংসদ সদস্য তাঁর সামনে গিয়ে যেভাবে তোয়াজ-তদবির করে তার সামান্যতম লক্ষণ তিনি আমার মধ্যে দেখলেন না। ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা লোকজনের মধ্যে যে রাজনৈতিক ভাবসাব কাজ করে তা আমার দ্বারা কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকল।
উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য নিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আমি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের চক্ষুশূলে পরিণত হলাম। কিন্তু টক শো, বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি এবং নির্বাচনি এলাকা এবং রাজনৈতিক মহলের সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকার কারণে জনপ্রিয়তা-পরিচিতি কিংবা গ্রহণযোগ্যতা, এমন সুযোগ আমার জন্য তৈরি হলো যা কি না, আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য, চাটুকার নেতাদের মধ্যে ঈর্ষার আগুন জ্বালিয়ে দিল। আমি তাদের ঈর্ষায় ঘৃতাহুতি দেওয়ার জন্য অকপটে নির্জলা সত্য অনেকটা শিশুর মতো ফটাফট বলা শুরু করলাম, যা কিনা জাতীয় গণমাধ্যমগুলো লুফে নিল। ফলে প্রায় প্রতিদিনই আমার কোনো কোনো বক্তব্য সংবাদপত্রের শিরোনাম হতো। পত্রিকায় নিজে কলাম লিখতাম প্রতি সপ্তাহে তিন-চারটি করে আর রোজ রাতে টক শো তো থাকতই।
সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, ব্যাংকখেকো খোকাবাবুর দল প্রমাদ গুনল। প্রথমে আকার-ইঙ্গিতে ভয় দেখাল, তারপর হুমকি। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হলো না, আমার স্পর্ধা বরং দিনদিন বাড়তেই থাকল আর এভাবেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং আওয়ামী লীগের ডি ফ্যাক্টো সভাপতি কাম প্রধানমন্ত্রী সালমান এফ রহমানের সঙ্গে আমার বিরোধ তুঙ্গে পৌঁছে গেল।
প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে বিরোধটি থামিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। কারণ তিনি দলের মধ্যে মতানৈক্য, অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ইচ্ছা করেই জিইয়ে রাখতেন। অধিকন্তু কেউ যদি বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং তাঁর পুত্রকন্যাদের বাদ দিয়ে দলের প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য কিংবা অপমান করতেন তবে সেটা তিনি উপভোগ করতেন। আর তিনি যাঁদের পছন্দ করেন না এমন বড় নেতার ধুতি ধরে টানাটানি করলে তিনি সেই দৃশ্য দেখে যারপরনাই আনন্দ পেতেন। ফলে আমার কর্মকাণ্ড নিয়ে দলের দুর্নীতিবাজদের প্রবল আপত্তি থাকলেও শেখ হাসিনা ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। উল্টো তিনি আমার পক্ষে অবস্থান নিতেন।
আমাকে কীভাবে দমানো যায়, কীভাবে আমার মুখ বন্ধ করা যায় অথবা কীভাবে আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া যায় তা নিয়ে বড় বড় রাঘববোয়াল বৈঠক শুরু করল। নির্বাচনি এলাকায় মরণফাঁদ তৈরি, ঢাকা শহরে মৃত্যুকূপ তৈরি, সামাজিকভাবে অপদস্থ করা, ব্যবসাবাণিজ্যের সর্বনাশ ঘটানো। দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিটিআরসিসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের মাধ্যমে আমার ওপর এমন চাপ তৈরি করা হলো, যাতে করে আমি আলুভর্তা হয়ে ওরে বাবা! ওরে মা বলে চিৎকার করতে থাকি। তারা আমার চরিত্রহননের জন্য হানিট্রাপের ব্যবস্থা করল, ডিজিএফআই-এনএসআইসহ ডিবি অফিসকে লেলিয়ে দিল। আর ওসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি আমার কলম ও জবাবের গতি বাড়িয়ে দিলাম। ফলে তারা আমাকে জেলে ঢোকানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করল এবং দুজন মন্ত্রী এবং দুজন পত্রিকার সম্পাদক দ্বারা আমাকে সর্বশেষ সতর্কবার্তা হিসেবে ১০ নম্বর বিপৎসংকেত জানিয়ে দিল।
২০১৩ সালে আমার শরীর-মনে যে তারুণ্য ছিল তা আমাকে আরও বেপরোয়া করে তুলল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলাকে আমি ইবাদত হিসেবে মনে করতে থাকলাম। ফলে ২০১৩ সালের জুলাই মাসের ২৫ তারিখ আমাকে বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিস থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। আমার গ্রেপ্তার, ডিবি অফিসে রাত্রিযাপন, পরের দিন আদালতে তোলা-জেলে প্রেরণ এবং ৪৯ দিন কারাবাসের পর মুক্তির ঘটনার নেপথ্যে এত্ত সব ঘটনা, দুর্ঘটনা, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, দুঃখকষ্ট, বেদনা ইত্যাদি জড়িত ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আজ মনে হয়, আমি যদি জেলে না যেতাম এবং স্বাভাবিক অবস্থায় মন্ত্রী-এমপি প্রধানমন্ত্রী হয়ে মারা যেতাম তবে আমার জীবনটি হতো এক অবোধ নাবালিকার জীবন যে কিনা ৮০-৯০ বছর ধরে দুনিয়াতে বসবাস করল এবং শেষ পর্যন্ত নবজাতকরূপে আজরাইলের দয়ায় কবরে চলে গেল।
জেলে বসে আমি জেলজীবন নিয়ে আত্মকথা লিখলাম। জেল থেকে বের হওয়ার পর সেই আত্মকথার পাণ্ডুলিপি বাংলাদেশ প্রতিদিন কর্তৃপক্ষকে দিলাম। তারা ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন প্রথম পৃষ্ঠায় আমার কারাবাসের কাহিনি ছাপতে আরম্ভ করল। বিরূপ সময়ে সরকারের রক্তচক্ষু এবং প্রভাবশালীদের শাসানির প্রতিকূলে বাংলাদেশ প্রতিদিন যথাসম্ভব সম্পাদনা করে দিন পনেরো ধরে আমার কারাবাসের কাহিনি ছাপল। সারা দেশে শুরু হলো তোলপাড়। কেউ কাঁদেন, কেউ হাসেন- আবার কেউবা ছি ছি রব তুলে সরকারর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে শুরু করলেন। ফলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ আর ছাপতে পারল না। পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক এমপির কারাদহন শিরোনামে সেই সময়ে লেখাগুলো প্রকাশ করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশিত হয় এবং সেই ২০১৩ সাল থেকে আজ অবধি বাজারে সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকায় শীর্ষ স্থানটি দখল করে আসছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এমপির কারাদহন বইটি আমি আবার পড়লাম। ২০১৩ সালের গুম-খুন এবং অন্ধকার জগতের কাণ্ডকারখানা নিয়ে ওই সময়ে যা লিখেছিলেন তা ২০২৪ সালের মুক্ত পরিবেশে পড়তে গিয়ে বারবার আঁতকে উঠেছি। এত সাহস আমার কোত্থেকে এসেছিল কিংবা কেন আমি ওসব করেছিলাম, তা আজকের পরিণত বয়সে এসে হিসাব মেলাতে পারি না। গ্রেপ্তারের অপমান আমার ওপর কী প্রভাব ফেলেছিল অথবা রাতে যখন একজন সংসদ সদস্যকে চোর-ডাকাতের মতো গ্রেপ্তার করে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আমার নিতম্ব-লজ্জাস্থান, হাঁটু, পায়ের পাতা এবং গুহ্যদ্বার কীভাবে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল- তা ভাবলে আমি পার্থিব জগৎ থেকে অপার্থিব জগতে চলে যাই।
আগেই বলেছি যে কারাবাস-গ্রেপ্তার নিয়ে আমি জীবনে কোনো দিন কল্পনাও করিনি। আমার চৌদ্দগুষ্টিতে মামলা-মোকদ্দমা, থানা-হাজত ও পুলিশি হয়রানি ইত্যাদির কোনো রেকর্ড নেই। পুলিশ দেখলে এখনো আমার হাত-পা কাঁপে। সেনাবাহিনী দেখলে জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হয়। জীবনে কারও সঙ্গে মারামারি করিনি আর পারিবারিকভাবে আমার আব্বা-আম্মা জীবনে কোনো দিন আমার শরীরে একটি ফুলের টোকাও দেননি। সুতরাং ডিবি অফিসে নিয়ে পশ্চাৎদেশে গরম ডিম ঢোকানো হলো, পা ওপরে তুলে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে টাঙিয়ে বেদম প্রহার করা হয় ইত্যাদি ভীতিকর গল্পকাহিনি যা কিছু শুনেছিলাম তা ঘটনার রাতে আমার মধ্যে নিদারুণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আমার লজ্জাস্থান বলতে থাকে ‘যদি আমার সঙ্গে একটি ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়- পশ্চাৎদেশ চিৎকার করতে থাকে, যদি রাজহংসীর বড় একটা ডিম ঢোকানো হয় তবে কী হবে? এসব মারফতি শব্দমালা যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ইলুয়েশন বলা হয়- আমাকে রীতিমতো পাগল বানিয়ে ফেলে।
ডিবি অফিস থেকে যখন সকালে আদালতে নেওয়া হলো তখন শরীর-মন-মস্তিষ্কের ওপর আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমি শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলাম, তারপর যখন কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হলো এবং আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রুমে থাকতে দেওয়া হলো তখন হঠাৎ করে এক অলৌকিক শক্তির সন্ধান পেলাম। আবদুস সালাম পিন্টু, ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিম, মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দারসহ সবাই আমাকে স্বাগত জানালেন। তখন রোজার মাস চলছিল। তাঁরা আমার জন্য ইফতারির আয়োজন করলেন। কিন্তু সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার হঠাৎ বোধোদয় হলো যে আমার মতো মুখরা লোককে গ্রেনেড হামলার আসামিদের সঙ্গে রাখা উচিত হবে না। ফলে আমার সম্পর্কে নতুন হুকুম এলো কাসিমপুর কারাগারে অনতিবিলম্বে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য।
কাসিমপুরে আমার জন্য বরাদ্দ করা কামরাটি এক-এগারোর সময় সালমান এফ রহমান ও মোহাম্মদ নাসিম সাহেব ছিলেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও সেখানে অনেক দিন ছিলেন। আর যে সেলের অধীন আমার কামরাটি ছিল সেখানে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী, এটিএম আজাহার, তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ছিলেন। তাঁরা সবাই আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাদের পাশের সেলে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা, ছাত্রশিবিরের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন নেতা এবং বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী থাকতেন। অদূরে হাই সিকিউরটি সেলে থাকতেন জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম। পুরো কারাগারে গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের অবাধ বিচরণ ছিল। তিনি আপন যোগ্যতায় সবার সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং আমরা বলতে গেলে সবাই তাঁর মেহমানদারিতে দিনরাত পার করছিলাম। সেসব দিনরাতে জেলের ভিতরে এবং বাইরে অনেক পিলে চমকানো ঘটনা ঘটত, যা আমি সাধ্যমতো আমার কারাদহন বইতে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশ প্রতিদিনে যখন তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, তখন সরকারি মহলে যে হইচই পড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ যেভাবে সরকারের ভিতরকার গুপ্ত কথা শুনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তার ফলে আওয়ামী সরকারের খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, সালমান-আনিসুল গং সর্বশক্তি নিয়োগ করে গণমাধ্যমের গলাটিপে মাঝপথে এমপির কারাদহনের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী দুঃশাসনের সেই দলিল বাংলাদেশ প্রতিদিন কর্তৃপক্ষ পুনরায় প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে শুনেছি। তাই আমার কারাজীবনের স্মৃতিকথার সারসংক্ষেপ আপনাদের কাছে পেশ করলাম।