সম্প্রতি বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা ব্যক্তিগত আলাপে দলীয় রাজনীতির হালচাল সম্পর্কে যা জানালেন, তা হতবাক হওয়ার মতো।
নির্বাচন নিয়ে দলের প্রস্তুতি কেমন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনজীবনে যেসব সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠেছে, তা অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। সাড়ে চার মাসেই তো তারা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এ কারণেই আমরা দ্রুত নির্বাচন চাইছি। জনজীবনের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের জন্য ‘রাজনৈতিক’ সরকার দরকার। কিন্তু সরকার সেই পথে হাঁটছে বলে মনে হয় না। সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ও ছাত্রনেতাদের কথাবার্তায় মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলোই সব সমস্যার মূলে। তাদের মনে রাখা উচিত, ৩৬ দিনের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়নি। এর পেছনে ১৫ বছরের আন্দোলন–সংগ্রাম ছিল।
আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা ও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার বিষয়টিও এল। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন অসুস্থ। তারপরও নেতা–কর্মীরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে তাঁর দেশে থাকা জরুরি। বিএনপির ওই নেতা জোর দিয়ে বললেন, ম্যাডামের বিদেশযাত্রার তারিখ যে বারবার পেছানো হচ্ছে, তা তাঁর অসুস্থতার জন্য নয়। চিকিৎসকেরা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর লন্ডনে যেতে কোনো বাধা নেই।
জিজ্ঞেস করি, তাহলে বারবার তারিখ পেছানো হচ্ছে কেন? উত্তরে আওয়ামী লীগ আমলে বহুবার জেলখাটা এই নেতা জানান, রাজনৈতিক মহলে নতুন দলের আওয়াজ উঠেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকেও তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
জানতে চাই, খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলে কেউ ভাঙন ধরাতে পারেন কি না? তিনি বললেন, দলে যে দ্বিতীয় কোনো শাহজাহান ওমর বা তৈমুর আলম খন্দকার নেই, সেটা কে বলতে পারে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দল ভাঙা কিংবা নেতা ভাগিয়ে নেওয়ার উদাহরণ কম নয়। অতীতের শাসকেরা ‘কিংস পার্টি’ গঠন করে কখনো সফল হয়েছেন, কখনো হননি। এবারও বাতাসে নানা কথা ভেসে আসছে। আবার বিএনপির ভেতরেও সমস্যা আছে। ৫ আগস্টের আগে সমস্যা ছিল সরকারের দমন–পীড়ন। আর এখনকার সমস্যা হলো দলের অনেক নেতা-কর্মী ক্ষমতায় না গিয়েও ক্ষমতার ‘স্বাদ’ পেয়ে গেছেন মনে করছেন। বিভিন্ন স্থানে দখলবাজি চাঁদাবাজির সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামও এসেছে।
তাঁর কথার সমর্থন পাওয়া গেল দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যেও। বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সমিতি আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘আমরা শুনছি গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা নাকি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য কাউকে কাউকে সমর্থন দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। এই ঘটনা এ দেশের মানুষ মেনে নেবে না।’
জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের পর থেকেই বিএনপির নেতারা ‘কিংস পার্টির’ কথা বলে আসছেন। তাঁরা এটিকে দেখছেন এক–এগারোর পরের ক্ষমতাসীনদের অভিলাষের সঙ্গে। আবার নাগরিক সমাজের কারও কারও সঙ্গে সংস্থার লোকজনের যোগাযোগ করার কথাও শোনা যাচ্ছে। এসব অভিযোগের জবাবে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা কোনো কিংস পার্টি গঠন করছি না। আমরা চব্বিশের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।’
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা গত ৮ সেপ্টেম্বর গঠন করেন জাতীয় নাগরিক কমিটি নামের প্ল্যাটফর্ম। তাঁরা ক্রমে দল গঠনের দিকে এগোচ্ছেন। ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার কথা আছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের দাবি, তঁাদের এই দল গঠনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই। তঁাদের দল ওপর থেকে কিছু চাপিয়ে দেবে না। বরং তৃণমূল থেকে তঁারা দল গুছিয়ে নিতে চান। ইতিমধ্যে অনেকগুলো উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
রুহুল কবির রিজভী মুদ্রার এক দিকের চিত্র তুলে ধরেছেন। অপর দিকের চিত্র হলো নির্বাচনী ডঙ্কা বেজে ওঠার আগেই প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ‘লড়াই’ শুরু হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের ড্রয়িংরুমে ধরনা চলছে। একটি আসনে একজনই মনোনয়ন পাবেন। সে ক্ষেত্রে ‘লড়াইয়ে’ হেরে যাওয়া ব্যক্তি কি চুপচাপ বসে থাকবেন? থাকবেন না। তিনি বিকল্প দলের সন্ধান করবেন।
অভিযোগের জবাবে নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘রাজনৈতিক দল গঠনে রাষ্ট্রীয় মদদ নেওয়ার প্রশ্নই আসছে না। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগও নেই, ধোঁয়াশাপূর্ণ বক্তব্যমাত্র। তাঁরা যখন আমাদের কিংস পার্টি বলেন, তখন জানতে চাই, অন্তর্বর্তী সরকার কার না? তাঁরা কি এই সরকারকে নিজেদের মনে করেন না? এই সরকার অন্য কেউ চালাচ্ছে? তাঁরা কি চান, এই সরকার না থাকুক, প্রশ্নবিদ্ধ হোক?’ (সমকাল, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪)
রাজনৈতিক পথ ও মত নিয়েও দু্ই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন মনে করে, একটি নির্বাচনের জন্য জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থান হয়নি। রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে। জনগণের সঙ্গে রাজনীতির নতুন বন্দোবস্ত হতে হবে। পুরোনো রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে, এটা স্বীকার করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপির নেতাদের দাবি, সংস্কার প্রস্তাব তো তাঁরা ২০১৬ ও ২০২৩ সালেই দিয়ে রেখেছেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক আরও একটি কথা বলেছেন। বিএনপিই বাংলাদেশের প্রথম কিংস পার্টি। কীভাবে? জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবহার করে প্রথমে জাগো দল, জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেন। পরে বিএনপি গঠিত হয়। দ্বিতীয় সেনাশাসক এরশাদও একই কায়দায় জাতীয় পার্টি গঠন করেছেন। জিয়া গণভোট দিয়ে ১৯ দফা ও এরশাদ ১৮ দফা কর্মসূচি পাস করিয়ে নেন। দুই কর্মসূচিই যথাক্রমে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র।
নির্বাচন নিয়েও বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের মতবিরোধ আছে। ছাত্রনেতাদের দাবি, কেবল একটি নির্বাচনের জন্য এত বড় গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। এতগুলো মানুষ জীবন দেননি। তাঁরা এক স্বৈরশাসকের জায়গায় আরেক স্বৈরশাসক পুনর্বহাল করতে চান না। বিএনপির নেতারা মনে করেন, রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে কোনো দল হলে সেটা স্বৈরতন্ত্র জন্ম দেবে, গণতন্ত্র নয়।
ছাত্রনেতাদের অভিযোগ, বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে তাঁরা বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর কাছ থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। হামলার শিকার হচ্ছেন। দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এক ছাত্রনেতা বলেছেন, সেখানে তাঁর কর্মসূচিতে না যাওয়ার জন্য কর্মীদের নির্দেশ দেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা। কিন্তু তারপরও যুবদল ও ছাত্রদলের কর্মীরা এসেছেন। রাতে গোপনে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ রকম ঘটনা অন্যত্র ঘটলে বিএনপির নেতৃত্বের ‘ভয়ের’ কারণ আছে বৈকি।
রুহুল কবির রিজভী মুদ্রার এক দিকের চিত্র তুলে ধরেছেন। অপর দিকের চিত্র হলো নির্বাচনী ডঙ্কা বেজে ওঠার আগেই প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ‘লড়াই’ শুরু হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের ড্রয়িংরুমে ধরনা চলছে। একটি আসনে একজনই মনোনয়ন পাবেন। সে ক্ষেত্রে ‘লড়াইয়ে’ হেরে যাওয়া ব্যক্তি কি চুপচাপ বসে থাকবেন? থাকবেন না। তিনি বিকল্প দলের সন্ধান করবেন। আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। গণতন্ত্র মঞ্চ কিংবা বাম গণতান্ত্রিক জোটেও তাঁরা ভরসা রাখতে পারবেন না। আবার মনোনয়নবঞ্চিত বিএনপির নেতারা ‘অসাম্প্রদায়িক’ চরিত্র বজায় রাখতে জামায়াতে ইসলামীতেও যেতে চাইবেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁরা সম্ভাব্য ‘কিংস পার্টির’ ওপরই ভরসা রাখবেন।
বিএনপির নেতৃত্ব ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মধ্যকার চাপান–উতোরের পেছনে এটাও বড় কারণ হতে পারে। জনগণের সেবার কথা বলা হলেও রাজনীতির মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।