জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এ বক্তব্যের পর জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে কি না, এ আলোচনা সামনে এসেছে। কারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় নির্বাচন করতে চাইলে তা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই করতে হবে। সংসদ নির্বাচন করার পর তারা আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সুযোগ পাবে না। তাদের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতপার্থক্য আছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিপক্ষে। আর জাতীয় নাগরিক কমিটি মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত। কোনো কোনো দল অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলছে।
সরকারের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের আস্থায় নিয়ে অগ্রাধিকার ঠিক করা। অন্যথায় সমস্যা বাড়বে।
এদিকে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানোরও প্রস্তুতি চলছে। এ লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন—সব স্তরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে একটি আইনের আওতায় নিয়ে আসাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব নিয়ে ভাবছে সংস্কার কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে কমিশন। কমিশনের মূল্যায়ন হলো, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। এর পক্ষে প্রধানত দুটি যুক্তি এসেছে। প্রথমত, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর স্থানীয় সরকারের অনেক জনপ্রতিনিধিও আত্মগোপনে চলে যান। একপর্যায়ে বেশির ভাগ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে নতুন নির্বাচন কমিশনের একটি পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা হবে। সরকারও সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলোচনায় স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষের মতামতের বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়।
ইউপি, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনকে এক আইনের আওতায় আনার কথা ভাবছে সংস্কার কমিশন।
গত বুধবার ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানান, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচন কবে নাগাদ হতে পারে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। যদিও চলতি বছরের শেষ বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে বলা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনগণ নিয়মিত সেবা পাচ্ছে না। প্রশাসক দিয়ে এটি সামলানোর ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মূলত এটি একটি প্রস্তাব আকারে স্যার (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি হয়, তাহলে নাগরিকদের এই সেবা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে অগ্রসর হতে পারব।’
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন দেবে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন মনে করে, দুটি কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা ও প্রয়োজনীয় আইনবিধি সংস্কার করে সরকার চাইলে চলতি বছরের জুন বা তার পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দিকে যেতে পারবে।
দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য
দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি ও এর মিত্র জোট ও দলের বেশির ভাগই বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন করা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব জাতীয় নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এর বাইরে অন্য কিছু বলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে লাভ নেই। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের বক্তব্য সামনে আনাই ঠিক হচ্ছে না, এতে জনমনে অন্য চিন্তা আসতে পারে। কারণ, মানুষ জাতীয় নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ দিতে পারে। আগামী দিনে নির্বাচিত সংসদে আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা ছাড়া এ বিষয়ে বলা মুশকিল। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, বর্তমানে দেশে সে অর্থে সাংবিধানিক সরকার নেই। আগে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তারপর অন্য নির্বাচন।
তবে ভিন্ন অবস্থান তুলে ধরছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তারা মনে করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়া উচিত। নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং পরে জাতীয় নির্বাচন এভাবে ধাপে ধাপে যাওয়া উচিত।
এ বিষয়ে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত চায় গণসংহতি আন্দোলন। দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি এবং সংবিধান ঠিক করার নির্বাচন। তাই এই নির্বাচন প্রধান গুরুত্বের বিষয় বলে তিনি মনে করেন।
অন্যদিকে যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সূত্রগুলো বলছে, নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্দেশনা দেবে। নির্বাচন কমিশন এখনো এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা পায়নি।
ঢেলে সাজানোর চিন্তা
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, কমিশন স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন আনার কথা চিন্তা করছে। এখন ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশনের জন্য আলাদা আলাদা আইন আছে। কিছু ক্ষেত্রে কাঠামোও ভিন্ন। কমিশন চায় একটি একীভূত আইনের অধীন সব কটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান চলবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন হয় আলাদা আলাদা সময়ে। এখন একটি এলাকায় ইউপি থেকে জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন—সব কটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন একই দিনে করার বিধান করার চিন্তা সংস্কার কমিশনের। এতে নির্বাচনের খরচ অনেক কমে আসবে। বর্তমানে স্থানীয় সরকারের মেয়র, চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান বাদ দেওয়ার বিষয়ে কমিশন অনেকটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিষদের চেয়ারম্যান বা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে সরাসরি ভোটে নির্বাচন করা হয়। এখানে পরিবর্তন আনার কথা ভাবা হচ্ছে। কমিশনের চিন্তা, সরাসরি ভোট হবে সদস্য বা কাউন্সিলর পদগুলোয়। সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে ভোট দিয়ে একজনকে মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন। উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি নির্বাহী কাউন্সিল গঠনের চিন্তা করা হচ্ছে। উপজেলাভুক্ত বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা ভোট দিয়ে উপজেলার চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কাউন্সিল নির্বাচন করবেন। তবে এ ক্ষেত্রে অর্থের লেনদেন বা মাথা কেনাবেচা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার বিষয়টিও মাথায় রাখা হচ্ছে। এটি ঠেকাতে আইনে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাজের পরিধি ও ধরন আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
এখন স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুরোধে নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। এখানে পরিবর্তন এনে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠান সরাসরি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে একটি ঐকমত্য গঠন করে এগোনোর কথা ভাবা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন আসলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। এত দিন ধরে যেটা চলে আসছে, সেটা কিছু প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি। সামগ্রিক কোনো কাঠামো সৃষ্টি হয়নি। একটি সামগ্রিক কাঠামো সৃষ্টি এবং ব্যবস্থা গড়ে তোলা তাদের লক্ষ্য। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে মতবিনিময়ে বিভিন্ন প্রস্তাবের পাশাপাশি তাঁরা অভিন্ন একটি মতামত পাচ্ছেন, সেটি হলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির কাজ শেষ হবে ফেব্রুয়ারি মাসে। এর আগেই ওই নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে। এতে জাতীয় নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তা করা হচ্ছে কি না, এই প্রশ্নে সরকারের প্রতি বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার অভাব ও সন্দেহ বাড়তে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের আস্থায় নিয়ে অগ্রাধিকার ঠিক করা। অন্যথায় সমস্যা বাড়বে।