- সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই দরকার, সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে নির্বাচিত সরকারকেই: অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
- দেশের রাজনীতি স্থানীয় দলসমূহ ও নেতাদের হাতে নেই, জটিলতা কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য: অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক
- এই বছরটা খুব জটিল হতে পারে, সবার ধৈর্য ও সংযমটা খুব জরুরি: অধ্যাপক আমেনা মোহসীন
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর (কয়েকদিন বাদে) শুরু হলো ইংরেজি নতুন বছর। সংস্কার, জাতীয় ঐক্য, নির্বাচন, আগে সংস্কার পরে নির্বাচন, ন্যূনতম সংস্কার করেই নির্বাচন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত- এমন অনেক শব্দের মারপ্যাচের মধ্যেই নতুন বছরের যাত্রা শুরু এদেশে। বিশেষ করে, সংস্কারের পরিধি ও নির্বাচনের সময়সীমা- এই দুই ইস্যুতে অভ্যুত্থানের পক্ষের অংশীজনদের মধ্যেও বহুমত দৃশ্যমান। ছাত্র-নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও হরেক আলোচনা। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধান, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ ইস্যু। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচারকাজ, অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকতায় ফেরানোর আলোচনা তো আছেই। এতসব দ্বন্দ্বে-ধন্দে এবছর কেমন হবে রাজনীতির ছবি?
এরকম প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-লেখক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, কঠিন সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন বছরে সবচেয়ে জরুরি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে জনগণের আস্থায় আনতে পারা। সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই দরকার। একটি আরেকটির বিকল্প নয়। সংস্কার নিজের গতিতে চলবে। এরমধ্যে নির্বাচনটাও করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকারও হলো- নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। সংস্কার কমিশনগুলো সুপারিশ প্রণয়ন করবে, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে নির্বাচিত সরকারকেই। অন্তর্বর্তী সরকার কতগুলো সুপারিশ চূড়ান্ত করে যেতে পারে। বিশেষ করে, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করার লক্ষ্যে সংস্কারকাজ শেষ করে নির্বাচন দেওয়া উচিত।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক বিভাজন থাকবেই। জনসভা, মিছিল-মিটিং দিয়ে এর সমাধান হবে না। যার যার মতাদর্শের ভিত্তিতে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে, মূল সংকটের মীমাংসা কিন্তু নির্বাচনের মধ্য দিয়েই। এটা বিবেচনায় রাখতে হবে।
বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ভঙ্গুর অর্থনীতির মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার চেষ্টা করছে অবস্থার উন্নতির জন্য। দুর্বল ব্যাংকগুলোতে সংকট কিছুটা হলেও কেটেছে। এই খাতে আরো উন্নতি দরকার। নতুন বছরে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরো সক্রিয় হতে হবে। বিশেষ করে, পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরানোর বিষয়ে সরকারকে আরো মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষাখাতে যে দলীয়করণ ঘটেছে সেখানে সংস্কার আনাও জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় বিবেচনায় যেন উপাচার্য বা অন্যান্য পদে নিয়োগ না হয়- সেটাই কাম্য।
রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, সমাজচিন্তক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের কাছেও একই প্রশ্ন রাখা হলে তিনি ইত্তেফাককে বলেন, দেশজুড়ে নানারকম চিন্তা দেখছি। কিন্তু, বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আর এদেশের রাজনৈতিক দলসমূহ ও স্থানীয় নেতাদের হাতে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কেউ রাজনীতিবিদ নন। প্রত্যেকেই ভালো ছাত্র ছিলেন, কর্মজীবনেও প্রত্যেকে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন সেটির বড় ঘাটতি রয়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দীর্ঘসময় ধরে যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছে, তাতে সামগ্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্য দিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারটি এসেছে। রাজনৈতিক যে জটিলতা ও ভঙ্গুর অর্থনীতি সেটা কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য। রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের ভিত্তিতে সামনে অগ্রসর হতে হবে। মোটকথা, রাজনীতির চরিত্র উন্নত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. আমেনা মহসিন ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নানা কারণেই মনে হচ্ছে নতুন বছরটা অনেক ক্রুশিয়াল হবে আমাদের জন্য। সেটা আমরা হয়তো উতরেও যেতে পারবো। তবে, এজন্য সবার ধৈর্য ও সংযমটা খুব জরুরি। তিনি বলেন, একদিকে অভ্যন্তরীণ নানা চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে সংস্কার ইস্যুতে। সংস্কার কতটুকু করা হবে, কতটুকু করতে পারবো- এটা বড় ইস্যু। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানারকম দাবি-দাওয়াও সামনে আসছে। সবকিছু ব্যালান্স করে সামনে এগিয়ে যেতে পারা কম চ্যালেঞ্জের নয়।
অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো কতটা নিজেদের মধ্যে সংস্কার আনতে পারবে, জনগণকে কীভাবে আস্থায় নিতে পারবে, একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জও সামনে আসছে। কিন্তু, মনে রাখা দরকার যে- সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, সংস্কারের কোনো শেষ নেই। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মিও এখন আমাদের বড় মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে। সবমিলিয়ে ২০২৫ সালটি অনেক ক্রুশিয়াল হবে বলে মনে হচ্ছে।