গদি রক্ষার জন্য যারা নিজেদের দেশের মানুষকে হত্যা করে, তারা কোনো রাজনৈতিক দল হতে পারে না মন্তব্য করে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেন, এরা সন্ত্রাসী দল। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যতগুলো হত্যাকাণ্ড করেছে, তার সব কটির বিচার বাংলার মানুষ চায়। একজন অপরাধীও যাতে বাংলার মাটিতে বাঁচতে না পারে তা আমরা দেখতে চাই। তাদের বিচার করতেই হবে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্য সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জামায়াতের আমির।
শফিকুর রহমান বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি–বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট নেত্রী লগি-বইঠা নিয়ে হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছিল; কিন্তু ক্ষমতার গরমে সেই মামলা তারা গিলে ফেলেছিল। সাময়িকভাবে গিলেছে কিন্তু হজম করতে পারেনি। এটা আপনাদের বদহজমের কারণ হবে।
আওয়ামী লীগকে নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, এরা রাজনৈতিক দল হতে পারে না। যারা ক্ষমতায় বসে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয়, দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারে না, গদি রক্ষার জন্য নিজের দেশের মানুষ হত্যা করে, তারা কোনো রাজনৈতিক দল হতে পারে না। তারা একটি সন্ত্রাসী দল। ইতিমধ্যে সরকার তাদের সন্ত্রাসী ছাত্রসংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তারা চর দখলের মতো দখল করে নিয়েছিল অভিযোগ করে জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমাদের কোমলমতি মেয়েদের বিদ্যাপীঠগুলোকেও তারা কলুষিত করেছে। এই কথা বলতে হৃদয় ভেঙে যায়, লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। এ জন্য এই কথাগুলো, চিৎকারগুলো দিতে পারি না, বলতে পারি না। কেমন অত্যাচার আমাদের মেয়েদের ওপর করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, যুবক ও ছাত্ররা অন্যায়, দুঃশাসন ও নির্যাতনের বিপক্ষে। এরা কখনো দুঃশাসন–দুর্নীতিকে মেনে নেয় না। তারা (আওয়ামী লীগ) এই দুটিকেই জাতিকে উপহার দিয়েছিল। এ জন্য ছাত্রসমাজ দফায় দফায় আন্দোলন করেছে। সর্বশেষ ’২৪–এর আন্দোলন করেছে। এসব আন্দোলন করার কারণে তারা বল প্রয়োগ করে অনেককে হত্যা করেছে।
জুলাই–আগস্ট অভ্যুত্থানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে শফিকুর রহমান বলেন, ‘হাত কাটা, পা কাটা, চোখ নেই। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন লাগে। বলেছে ভালো লাগে। বললাম আহত অবস্থায়, রক্ত ঝরছে তুমি দেখো না, তা–ও তোমার ভালো লাগে? কেন তোমার ভালো লাগে? বলল যে কারণে লড়াই করেছিলাম, সেই লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছি।’
১৯৭১ সালেও এই জাতি দেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়াই করেছে উল্লেখ করে জামায়াতের এই শীর্ষ নেতা বলেন, ১৯৭১ সালেও একটা স্বাধীনতা এসেছিল। এই জাতি এনেছিল; কিন্তু স্বাধীনতার মর্মবাণী ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। স্বাধীনতার ফসল বাংলাদেশের মানুষের পকেটে ও ঘরে ওঠেনি। একটা গোষ্ঠী এটাকে হাইজ্যাক (ছিনতাই) করেছিল। আরেকটা দেশের হাতে এটা তুলে দিয়েছিল। তার জ্বলন্ত প্রমাণ এই ২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাশের দেশের প্রধানমন্ত্রী তিনি বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা দিতে গিয়ে ভারতীয় সৈনিক–সেনাপতিদের দিয়েছেন; আর বলেছেন, এটা ভারতের বিজয় দিবস।
শিক্ষা যেহেতু জাতির মেরুদণ্ড, তাই ওই জায়গায় বেশি আঘাত বিগত সরকার দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন জামায়াতে ইসলামীর আমির। তিনি বলেন, ‘উদ্দেশ্যহীন, মানহীন একটা শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, যা বাস্তব জীবনে এই জাতির কম কাজে এসেছে। শিক্ষায় কোনো গবেষণা নেই, চর্চা নেই, উৎকর্ষ নেই, মিল তাই নেই, সবকিছুকে তছনছ করে দেওয়া হয়েছিল।’
ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের উদ্দেশে শফিকুর রহমান বলেন, আরেকটি যুদ্ধ করার জন্য তোমাদের তৈরি হতে হবে। সে যুদ্ধটি হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সবার আগে মেরামত করার। শিক্ষা যেহেতু জাতির মেরুদণ্ড, এই জায়াগায় তোমাদের শপথ নিতে হবে। আর কোনো চাপাতি কোম্পানিকে ওখানে ঢুকতে দেবে না। কোনো গাঁজাখোরকে ওখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না। হাতে অস্ত্র নিয়ে ওখানে ঢুকতে দেওয়া হবে না। গণরুম যারা কায়েম করে, তাদেরও ঢুকতে দেওয়া হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজি যারা করবে, তাদেরও স্থান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু শিক্ষা, শিক্ষার চর্চা, গবেষণা থাকবে। জামায়াত আমির বলেন, ‘এই যুদ্ধে আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। যেভাবে ৩৬ জুলাই পর্যন্ত তোমাদের সঙ্গে ছিলাম, আগামীতেও তোমাদের সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার আমরা করছি।’
জাতীয় ঐক্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, জাতীয় ঐক্যের কোনো ক্ষতি হয়, এ ধরনের সব হটকারী আচরণ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে শফিকুর রহমান বলেন, ‘বিভেদ নয়, ঐক্য চাই, সবাই মিলে দেশ গড়তে চাই।’
সম্মেলনে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘নতুন করে আমাদের মধ্যে কিছু কিছু বিভ্রান্তি ও ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টি করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের মধ্যে যদি সামান্যতম ফাটল ধরে, তাহলে পুনরায় ফ্যাসিবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াবে।’
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন ৮ আগস্ট (৫ তারিখে গুলিবিদ্ধ) শহীদ হওয়া রাজশাহী মহানগর ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক আলী রায়হানের বাবা মুসলেহ উদ্দিন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জুলাই বিপ্লবের শহীদ আবু সাঈদ, ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, ওয়াসিম, উসমানসহ শহীদ পরিবারের সদস্যরা এবং আওয়ামী লীগের আমলে নির্যাতনে আহত ও গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা আবদুল হালিম।
সদস্য সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুফতি কাজী ইবরাহীম, বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা জয়নুল আবেদীন, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শামছুল আলম, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন জাফরী। লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণ অধিকার পরিষদের (রেজা কিবরিয়া) ফারুক হাসান, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন প্রমুখ।
ছাত্রনেতাদের মধ্যে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, জাগপা ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রহমান ফারুকী, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের (ববি হাজ্জাজ) সভাপতি মাসুদ রানা জুয়েল প্রমুখ।
সম্মেলনে বিদেশি অতিথিও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আনাদোলু গেঞ্জলিক দেরনেইয়ের সহসভাপতি এমরুল্লাহ ডেমির, পেরসাতুয়ান কেবাংসান পেলাযার ইসলাম মালয়েশিয়ার সভাপতি জুল আইমান, হিকমত ইয়ুথ মিসরের সভাপতি আবদুল্লাহ আহমেদ, ইসলামী বিশ্ব যুব ফোরামের সভাপতি আশরাফ আওয়াদ, আংকাতান বেলিয়া ইসলাম মালয়েশিয়ার সভাপতি আহমদ ফাহমি মোহাম্মদ সামসুদিন প্রমুখ।