Saturday, December 28, 2024
Home » চাঁদা না পেয়ে সাবেক বিএনপি নেতার মামলার ফাঁদ

চাঁদা না পেয়ে সাবেক বিএনপি নেতার মামলার ফাঁদ

by radesk
0 comments

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এক শিক্ষার্থী চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার অভিযোগে করা মামলা নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীতে বিএনপির সাবেক এক নেতা বাণিজ্য শুরু করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও চাঁদা না পাওয়ায় আইনজীবী হিসেবে তিনি অনেকের নাম আসামির তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এখন মামলা থেকে আসামিদের নাম বাদ দিতে চাঁদাবাজি করছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে চোখে গুলিবিদ্ধ হন টঙ্গীর সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল মামুন। এ ঘটনায় ১৩ নভেম্বর ২০৩ জনের নামে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন তাঁর বাবা আসান উল্লাহ। আসামির তালিকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর বাইরে শিক্ষক, স্থানীয় ব্যবসায়ী, বাড়িওয়ালা, স্কুলছাত্র, গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেকের নাম রয়েছে। তাঁদের সবার বাড়ি টঙ্গীতে।

এই মামলা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠা জিয়াউল হক ওরফে জিএস স্বপন গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বাসা টঙ্গীর দত্তপাড়া লেদুমোল্লা সড়কে। তিনি পেশায় আইনজীবী। বর্তমানে তাঁর দলীয় পদ নেই। তবে এলাকায় আধিপত্য দেখান বিএনপির নেতা পরিচয়ে।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক মো. নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার নামে তাঁর (জিয়াউল হক) চাঁদাবাজির খবর আমাদের কানেও এসেছে। তবে এ ব্যাপারে কেউ লিখিত অভিযোগ দেননি।’ মামলার তদন্তে কারও সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলে নাম বাদ দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

আইফোন ‘না পাওয়ায়’ আসামি ঠিকাদার

টঙ্গীর দত্তপাড়া হাসান লেনের বাসিন্দা কবির হোসেন পেশায় ঠিকাদার। তিনি অভিযোগ করেন, ৫ জুলাই স্থানীয় একটি মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কৌশলে তাঁর আইফোন ও নগদ ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন জিয়াউল হক। এ ঘটনায় টঙ্গী পূর্ব থানায় লিখিত অভিযোগ করেন কবির। পরে বাধ্য হয়ে শুধু মুঠোফোন ফেরত দেন জিয়াউল।

এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে কবিরকে ফোন করেন জিয়াউল। আগের ঘটনার জেরে হুমকি দিয়ে নতুন একটি আইফোন কিনে দিতে বলেন। এতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে মামলায় আসামি (১৫৬ নম্বর) করা হয় বলে অভিযোগ কবিরের। মুঠোফোনে কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ডেও জিয়াউলকে হুমকি দিতে শোনা যায়।

কবির হোসেন বলেন, বাদী তাঁকে চেনেন না, দেখেনওনি। জিয়াউল হককে ফোন কিনে না দেওয়ায় তিনি কৌশলে মামলায় নাম দিয়েছেন।

এদিকে কবির হোসেনের মুঠোফোন ও টাকা নেওয়ার পর স্থানীয়ভাবে মীমাংসা বৈঠক হয়েছিল। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দত্তপাড়ার বাসিন্দা মো. হামিদ মোল্লা ওই বৈঠকে জিয়াউলকে ‘চোর’ আখ্যা দেন। এর জেরে ১০ আগস্ট জিয়াউল লোকজন নিয়ে তাঁর বাড়িতে হামলা চালান বলে অভিযোগ। এ পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ আগস্ট টঙ্গী পূর্ব থানায় জিডি করেন হামিদ মোল্লার মেয়ে তাবাসসুম।

হামিদ মোল্লা বলেন, বিচারে চোর বলায় জিয়াউল তাঁদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। পরে থানায় জিডি করলে তিনি, তাঁর ছেলে (১১) ও জামাতার নাম মামলার তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন জিয়াউল।

‘চাঁদা না দেওয়ায়’ আসামি ৮ স্কুলশিক্ষক

মামলায় অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. মনিরুজ্জামান, সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আবুল কাশেম, ক্রীড়াশিক্ষক মো. মোস্তফা কামাল, গাছা বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ মো. মনির হোসেন, টঙ্গী পাইলট স্কুল অ্যান্ড গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ মো. আলাউদ্দিন মিয়া, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. হানিফ উদ্দিন, প্রদর্শক মো. আবু জাফর আহমেদ এবং সিরাজউদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতন অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মজিবুর রহমান।

এসব শিক্ষকের অভিযোগ, ৫ আগস্টের পর তাঁদের ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিভিন্নভাবে চাঁদা দাবি করেন জিয়াউল। না দেওয়ায় তাঁদের আসামি করা হয়।

মো. হানিফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৬-১৭ অক্টোবর জিয়াউল ৫০ হাজার টাকা চাঁদা চেয়ে একজন লোক পাঠান। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন। এর জেরে অন্যান্য শিক্ষকের সঙ্গে আমাকেও মামলায় ফাঁসান।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জিয়াউল হক দাবি করেন, বাদীর ছেলে ও তাঁর বন্ধুদের দেওয়া নাম তিনি কেবল আইনজীবী হিসেবে লিখেছেন। কয়েকজনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের কথা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘কবির আমার বাড়ির ঠিকাদার ছিল। সে কাজ শেষ না করেই চলে গেছে। সে নিজেই খেতে পায় না। তার কাছে আইফোন চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর হানিফ নামে আমি কোনো শিক্ষককে চিনি না। হামিদ মোল্লা এলাকার চিহ্নিত অত্যাচারী আওয়ামী লীগ নেতা। তাঁর ছেলেও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তাঁর সব অভিযোগ মিথ্যা।’

মামলায় আসামিদের নামগুলো কে দিয়েছেন, জানতে চাইলে বাদী মো. আসান উল্লাহ বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না।’ তবে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আসান উল্লাহ বলেছিলেন, পুরো মামলাটি স্বপন ভাই (জিয়াউল হক) করিয়েছেন। আর মামলায় এত নাম দেওয়া হবে, তা তিনি জানতেন না।

মামলা থেকে নাম কাটাতে চাঁদা আদায়

মামলা থেকে নাম বাদ দিতে আসামিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগও উঠেছে জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে। ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি ‘বাদী আসামিকে চেনেন না’ মর্মে একটি হলফনামা করে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন জাপান স্টিল নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক মো. নূরানী (৩১ নম্বর আসামি) এবং স্থানীয় রড ব্যবসায়ী মো. কামাল (৩২ নম্বর আসামি) ও তাঁর ছেলে মো. মাসুদ রানা (১০৩ নম্বর আসামি)।

মাসুদ রানা বলেন, তাঁর বাবার কাছে ১০ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিলেন জিয়াউল। কিন্তু টাকা না দেওয়ায় পরে বাবা ও ছেলেকে মামলায় ফাঁসান।

জানতে চাইলে আইনজীবী জিয়াউল হক বলেন, ‘মামলা থেকে আসামির নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাদীর নিজের। আমি শুধু প্রক্রিয়া করে দিয়েছি। এ সময় আসামিরা খুশি হয়ে বাদীর ছেলের চিকিৎসার জন্য বাদীকে খরচ দিয়েছেন।’

তবে মামলার বাদী মো. আসান উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দু-তিনজন লোক মামলা থেইক্যা নাম উঠাইব জানাইয়্যা স্বপন ভাই (জিয়াউল হক) আমারে ফোন দিয়া বাড়ি (ময়মনসিংহের ত্রিশাল) থেইক্যা আসতে বলেন। পরে আমি আইলে আমাকে নিয়া কোর্টে যান। সেখানে আমি তাঁদের নাম উঠাইয়্যা দেই (চেনেন না মর্মে হলফনামা)।’

এ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বপনের (জিয়াউল হক) এসব অনিয়মের কথা আমরাও শুনেছি। অনেকে অভিযোগও করেছেন। যেহেতু তাঁর দলীয় পদ নেই, তাই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। তবে আমরা আদালতে সবাইকে বলে দিয়েছি, যেন তাঁর এ ধরনের কোনো মামলা এন্ট্রি করা না হয়।’

You may also like

Leave a Comment

Rajneeti Ajkal is a leading news portal dedicated to providing comprehensive coverage of news, current affairs, political analysis, and the contemporary landscape of Bangladesh.

Rajneeti Ajkal, A Media Company – All Right Reserved. Designed and Developed by Rajneeti Ajkal