‘কিংস পার্টি’ কে? বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল), নাকি জাতীয় নাগরিক কমিটি– এই বাহাসে জড়িয়ে পড়েছেন উভয় সংগঠনের নেতারা। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় মদদে নাগরিক কমিটি রাজনৈতিক দলের রূপ পেতে যাচ্ছে। ছাত্রনেতারা এ ভাষ্য নাকচ করে বিএনপিকে উল্টো সফল ‘কিংস পার্টি’ বলছেন।
রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যবহারে গঠিত দলকে রাজনীতিতে ‘কিংস পার্টি’ বলা হয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থনে বিগত নির্বাচনের আগে বিএনএম (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন) এবং তৃণমূল বিএনপি তৈরি হয়। এই দু’দলে বিএনপি নেতাদের ভাগিয়ে নিতে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার চাপ ও প্রলোভন ছিল। এর আগে তৈরি হয়েছিল বিএনএফ (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট)।
সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সরকারের সময় পিডিপি (প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি) গঠনের প্রকাশ্য প্রচেষ্টা ছিল। এতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাগিয়ে আনার চেষ্টা হয়। ক্ষমতায় থেকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৬ সালে গঠন করেন জাতীয় পার্টি। এতে আবদুল মতিনের নেতৃত্বে বিএনপির একাংশ এবং মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশ এতে যোগ দেয়। ভাগিয়ে আনা হয় অন্যান্য দলের নেতাদেরও।
পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি রাষ্ট্রপতি হন। ওই বছরই বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। গঠিত হয় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল)। এটিসহ ছয় দলীয় জোট জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পরের বছরের ৩ জুন সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন জিয়াউর রহমান। এর তিন মাসের মাথায় তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় বিএনপি।
তাই ছাত্রনেতৃত্ব উল্টো বিএনপিকে কিংস পার্টি বলছে। এ তকমার জবাবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদ্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে বলেন, ‘বিএনপির বয়স এখন ৪০ বছরের বেশি। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল।’
সম্প্রতি নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপিকে ‘কিংস পার্টি’ বলে আখ্যা দেন। বিএনপি নেতাকর্মীরা এর সমালোচনা করছেন। এ বিষয়ে কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমীন বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে সফল কিংস পার্টি হলো বিএনপি। সবচেয়ে নিপীড়িত দলেরও একটি বিএনপি। তাদের এই দুটি দিকই আমরা দেখি।’
তবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী খোলাখুলি অভিযোগ করেছেন, নতুন দল গঠনে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
নাগরিক কমিটির নাম না নিয়ে তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘কারা নির্বাচিত হবে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি তা নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে এ আত্মত্যাগের কী দাম থাকবে?’
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপিকে ভাঙার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ক্ষীণ প্রচেষ্টা কাজ করছে কিনা, তা নিয়ে জনগণের ভেতরে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে বলেন, ‘প্রত্যেকের রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার রয়েছে। কেউ দল গঠন করলে স্বাগত জানায় বিএনপি। তবে দেখতে হবে, সেই দল জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে কিনা।’
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা গত ৮ সেপ্টেম্বর গঠন করেন জাতীয় নাগরিক কমিটি নামের প্ল্যাটফর্ম। তারা ক্রমে দল গঠনের দিকে এগোচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন সমকালকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দল গঠনে রাষ্ট্রীয় মদদ নেওয়ার প্রশ্নই আসছে না। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগও নেই, ধোঁয়াশাপূর্ণ বক্তব্য মাত্র। তারা যখন আমাদের কিংস পার্টি বলেন, তখন জানতে চাই, অন্তর্বর্তী সরকার কার না? তারা কী এই সরকারকে নিজেদের মনে করেন না? এই সরকার অন্য কেউ চালাচ্ছে? তারা কি চান এই সরকার না থাকুক, প্রশ্নবিদ্ধ হোক?’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালে আদালতের রায়ের প্রতিবাদে ১ জুলাই আন্দোলন শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি। ছাত্র অধিকার পরিষদ, ছাত্র ফ্রন্টসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ছিলেন এতে। পদত্যাগ করে ছাত্রলীগ নেতারাও যোগ দিয়েছিলেন আন্দোলনে।
নিহতের সংখ্যা বাড়ার পর আন্দোলন রূপ নেয় অভ্যুত্থানে। শেখ হাসিনার পতনের পর জানা যায়, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ছাত্রদলের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল। এই দুই সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী প্রাণ দেন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সব বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছিল। এসব সত্ত্বেও অভ্যুত্থানের সূত্রপাত করা ছাত্রনেতারা রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসেন পরের ঘটনাপ্রবাহে। এরই মধ্যে তিন নেতা সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে নাগরিক কমিটির রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সামান্তা ইসলাম। ছাত্র উপদেষ্টাদের দল থাকলে তা স্বার্থের সংঘাত কিনা– প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘অবশ্যই স্বার্থের সংঘাত। ড. ইউনূস এবং ছাত্রনেতাদের যারা উপদেষ্টা, তারা অবশ্যই আমাদের অংশ। কিন্তু তারা দলে আসবেন, এমন কোনো আলাপ নেই আমাদের মধ্যে।’
নাগরিক কমিটি কি বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চাইছে– প্রশ্নে সংগঠনটির মুখপাত্র বলেছেন, ‘রাজনৈতিক পরিসরে সবার সঙ্গে মিলে কাজ করতে চাই। এমন পরিস্থিতি না হোক, যাতে প্রতিপক্ষ হয়ে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ পিছিয়ে পড়ুক।’
ছাত্রনেতারা বিএনপির সমালোচনা করলেও নিজেদের ‘চব্বিশের জিয়া’ বলে পরিচিত করাতে চাইছেন। সংগঠনটির একাধিক নেতা সমকালকে বলেছেন, বিএনপির সবচেয়ে বড় সম্পদ জিয়ার নাম এবং তাঁর সততা। জিয়ার মতো একজন জাতীয় বীরের উত্তারাধিকার আর বিএনপিকে একা ভোগ করতে দেওয়া হবে না। বয়স ও অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়াও সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন কিনা, তা অনিশ্চিত। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সহানুভূতি রয়েছে সাধারণ মানুষের। তাই খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের ‘মেরুদণ্ড’ আখ্যা দিয়ে এ অংশকে তুষ্ট রাখতে চাইছেন ছাত্রনেতারা। তাদের মূল্যায়ন, জিয়া এবং খালেদার প্রতি ইতিবাচক থাকলে বিএনপির সঙ্গে বাহাস চললেও শত্রুতার সম্পর্ক হবে না।