আমদানিনির্ভরতার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য গন্তব্য; এশিয়ায় ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে। তবে উৎপাদনে মনোযোগী না হওয়ায়, প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা না বাড়ানোর কারণে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের এই সুফল নিতে পারেনি ঢাকা। বিগত ১৫ বছরে এ বাণিজ্য অংশীদারি লাভের গুড় চলে গেছে দিল্লির হাতে। আমদানিনির্ভরতার কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চলে যাচ্ছে ভারতে।
দুই দেশের বাণিজ্যের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভারত থেকে ২০২২ সালে ৬ হাজার ৫২ ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এ পণ্য আনার জন্য ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশ ভারতে ১ হাজার ১৫৪ রকমের পণ্য রপ্তানি করেছে। এতে আয় হয়েছে মাত্র ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনা মহামারির কারণে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ আমদানি কমিয়ে দেয়। তারপরও ওই বছর ভারত থেকে ১২ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য এসেছে। ওই বছর বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে, প্রতি বছর তার ছয় থেকে আট গুণ বেশি পণ্য আমদানি করছে ভারত থেকে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ভারতের ওপর এই আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে গত ১৫ বছরে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত সরকারের বিশেষ সম্পর্কও আমদানি বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। আলোচ্য সময়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে সীমান্ত এলাকায় একের পর এক স্থলবন্দর, শুল্ক স্টেশন ও বর্ডারহাট স্থাপন হলেও এগুলোর মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়েছে ভারত। দেশটি থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে পণ্য আমদানির তালিকা বেড়েছে। বিপরীতে অবকাঠামো সমস্যা, অশুল্ক বাধা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ না থাকায় দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি সেভাবে বাড়েনি। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে।
ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ইন্ডিয়া ব্র্র্যান্ড ইক্যুয়িটি ফাউন্ডেশন (আইবিআইএফ)-এর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ যে ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে বিভিন্ন রকমের পণ্য। এই হরেকপণ্যের মধ্যে পিঁয়াজ, রুসুন, আদা,, ডাল, সুই, শুটকি থেকে শুরু করে পান, চিনি, লবণ, তেল, সাবান, শেম্পু এমনকি মুরগির খাদ্য ও ডিমও রয়েছে। আইবিআইএফ এটিকে ‘অন্যান্য পণ্য’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, গত অর্থবছরে ভারত থেকে এই অন্যান্য পণ্য আমদানি হয়েছে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারের; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারের কটন ইয়ার্ন বা তুলার সুতা আমদানি হয়েছে; তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮১৬ মিলিয়ন ডলারের পেট্রোলিয়াম পণ্য এবং ৪র্থ ৫৫৬ মিলিয়ন ডলারের চাল, গম, ভুট্টাসহ সিরিয়াল খাদ্যপণ্য এবং ৪র্থ সর্বোচ্চ আমদানি পণ্য হিসেবে তুলাজাতীয় কাপড় ও অন্যান্য তৈরি পণ্য এসেছে ৫৪১ মিলিয়ন ডলারের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সস্তায় ও দ্রুত পণ্য আনা যায় বলে পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছে। এই নির্ভরশীলতা কাটানোর জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। বিশেষ করে চাল, পিঁয়াজসহ যেসব খাদ্যপণ্য উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে- সেসব পণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, নিজস্ব উৎপাদন, প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা ও উৎপাদন প্রতিস্থাপন পণ্যের শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে আমদানি কমানোর সুযোগ রয়েছে। এ ধরনের শিল্প স্থাপন হলে শুধু ভারত থেকে আমদানি কমবে তাই নয়, দেশটির বিনিয়োগকারীরাও এসব শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।
কী আসে ভারত থেকে : আমদানিকারকরা বলছেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে কী আসে- এমন প্রশ্ন না করে বলা উচিত ভারত থেকে বাংলাদেশে কী না আসে। খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি, ট্রয়লেট্রিজ, যানবাহন, ওষুধ এবং নিত্যপণ্য ছাড়াও প্রয়োজন নাই এমন পণ্যও আমদানি হয়। আর পার্শ্ববর্তী এই দেশটি থেকে অবাধ আমদানি বেড়েছে মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের গত পনের বছরে। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে এ পর্যন্ত ২৪টি শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২টি স্থলবন্দরের কার্যক্রম চলছে। এর বাইরে প্রায় অর্ধশত শুল্ক স্টেশন রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমেও দুই দেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলে। কয়েকটি স্থলবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে গবাদিপশু, তাজা ফলমূল, গাছগাছড়া, বীজ, গম, পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, কতাঠ, টিম্বার, চুনাপাথর, পিঁয়াজ, মরিচ, রসুন আদা, বলক্লে, ব্যবহার্য কাঁচা তুলা, চালম, মসুর ডাল, কোয়ার্টজ, তাজা ফুল খৈল, গমের ভূসি ভুট্টা, চালের কুঁড়া, সয়াবিন কেক, শুঁটকি মাছ, হলুদ, জীবন্ত মাছ, হিমায়িত মাছ, পান, মেথি, চিনি, মসলা, জিরা, মোটর পার্টস, স্টেইনলেস স্টিল, রেডিও-টিভি পার্টস, মার্বেল স্লাব, শুকনো তেঁতুল, ফিটকারি অ্যালুমিনিয়াম, কিচেনওয়্যার, ফিস ফিড, আগরবাতি, জুতার সোল, শুকনা কুলসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি হয়েছে এই স্থলবন্দর দিয়ে। এর বাইরে দিনাজপুরের হিলি, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা, সিলেটের জকিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর, ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া, শেরপুরের নাকুগাঁওসহ বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সারা বছরই নানা ধরনের পণ্য আমদানি হয়। এসব বন্দরের বেশির ভাগের কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত ১৫ বছরে।
অবাধ আমদানির সুযোগ থাকলেও রপ্তানি সুবিধা কম : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মূল পথ ছিল যশোরের বেনাপোল দিয়ে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণের সূত্র ধরে দেশের অন্যান্য স্থলবন্দর দিয়ে ব্যাপকভাবে পণ্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়। স্থলবন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ১৫ বছরে বিভিন্ন সীমান্তে স্থলবন্দরগুলো চালু করা হলেও এ থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা খুব একটা লাভবান হতে পারেননি। শেরপুরের নাকুগাঁও আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ভারতের সঙ্গে আমাদের যেসব স্থলবন্দর রয়েছে, তার বেশির ভাগ দিয়েই দেশটি সর্বোচ্চ পণ্য রপ্তানির সুযোগ নেয়; বিপরীতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুযোগ খুবই কম।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)-এর প্রেসিডেন্ট আশরাফ আহমেদ বলেন, ওষুধসহ বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আসে ভারত থেকে। অন্যান্য পণ্যও আমদানি হয়। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। এই নির্ভরশীলতা রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব পণ্য ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে আনা যায় সেসব পণ্য আমদানিতে নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিগত সময়ে আমরা খাদ্যসহ নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে একটিমাত্র দেশের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এ ধরনের অতিনির্ভরশীলতার কারণে নির্ভরশীল দেশ সবসময় ক্ষতির মুখে পড়ে। এই ক্ষতি থেকে বাঁচতে বাংলাদেশকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যেসব পণ্য উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে, সেগুলোর উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। যেসব পণ্য উৎপাদনের সুযোগ কম, সেগুলো আমদানির জন্য বিকল্প উৎস্য অনুসন্ধান করতে হবে।