বাংলাদেশে তোমরা যারা আমার সন্তানকে নিয়ে হইচই করতে তারা একবারও ভাবনি যে পিতা হিসেবে আমি তোমাদের জীবনকে কীভাবে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলতে পারি। আমার সন্তানের কর্মকাণ্ডে যারা হা-পিত্যেশ করতে এবং বলতে এটা কোনো কথা হলো, এটা কোনো দেশ হলো! একটা দেশে কী করে গায়েবি মামলা হতে পারে। যেখানে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়নি সেখানে চুপিসারে থানা-পুলিশ মস্তবড় এক ফৌজদারি মামলা দায়ের করে রাখল। তারপর কয়েক মাস পরে কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক বছর পর হঠাৎ করে কোথাও একটা পটকা ফোটানো হলো অথবা পেট্রোল দিয়ে দু-চারটি পুরনো গাড়ির টায়ার পোড়ানো হলো এবং সেই ঘটনার সূত্র ধরে শখানেক লোককে মামলায় ফাঁসানো হলো এবং হাজারখানেক লোককে অজ্ঞাত আসামি বানিয়ে ঘুষ-দুর্নীতি, জুলুম-অত্যাচার এবং গ্রেপ্তার বাণিজ্যের বিরাট এক কারখানা খুলে ফেলা হলো।
প্রায় এক যুগ ধরে উল্লেখিত উপায়ে সারা বাংলায় আমার সন্তানের যে সুনাম-সুখ্যাতি হয়েছে তাতে করে গর্বে আমার বুকের পাটা হিমালয়ের মতো প্রশস্ত আর উঁচু হয়ে গিয়েছিল। আমার সন্তানের মাধ্যমে যারা দুটো দানাপানি খেত তারা পুরো সমাজের মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। আর যারা দানাপানির চেয়েও বেশি কিছু পেত, তারা তো সকাল-বিকাল আমার সন্তানের পুজো করত এবং মনে মনে বলত ভ্যাগ্যিস গায়েবি মামলার মতো বিস্ময়কর জিনিস যদি পয়দা না হতো, তবে তো আমাদের অস্তিত্বই থাকত না। তারা তাদের রাজাসন,
রাজভবন, রাজভোগ, হাতি-ঘোড়া, তলোয়ার, হম্বিতম্বি ইত্যাদির নিয়ামক হিসেবে গায়েবি মামলার অবদানকে মাথা নিচু করে স্বীকার করত এবং টুপি খুলে অভিবাদন করত। তারা আমার সন্তানকে নিজেদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে পিতার আসনে বসিয়ে যত্ন-আত্তি-তোয়াজ-তদবির করত। আর সেই দৃশ্য দেখে আমার যে কী ভালো লাগত তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। তৃপ্তিতে আমি হররোজ ঢেঁকুর তুলতাম আর আমার সন্তানকে যারা পিতা মনে করত- সেসব নাতি-নাতনির তুলতুলে গালে দূর থেকে উড়ন্ত চুম্বন বর্ষণ করে আমি তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করতাম।
আমি এতক্ষণ ধরে আমার সন্তানের কিচ্ছা-কাহিনির কিয়দংশ বর্ণনা করলাম। এবার আমার নিজের কাহিনি শোনাব। আজ আমি ক্ষুব্ধ ভারাক্রান্ত এবং যারপরনাই বিরক্ত। কারণ গণ অভ্যুত্থানে আমার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে, আমার নাতি-পুতিরা সব ধরা খেয়েছে, অনেকে ভেগেছে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বুড়ো বয়সে আমি মাঠে হাজির হয়েছি। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমি আমার অতীত অভিজ্ঞতা, শক্তি-সাহস এবং শয়তানি বুদ্ধি দ্বারা তোমাদের মনে এমন এক আতঙ্ক তৈরি করে ফেলেছি যার কারণে তোমরা অনেকেই বলতে শুরু করেছ এই বুইড়া গাণিতিক মামলার চেয়ে আগের গায়েবি মামলাই ভালো ছিল। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমি কেন অভদ্রের মতো তোমাদের তুমি বলে সম্বোধন করছি তা নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা আবশ্যক।
আমি জানি, তোমাদের বেশির ভাগ লোকই শক্তের ভক্ত, নরমের যম। ভদ্রতা তোমাদের সহ্য হয় না। সৌজন্যতা তোমাদের বদহজম সৃষ্টি করে। তোমরা অল্পতে রেগে যাও এবং খুব সহজে ভয় পাও। অস্থিরতা তোমাদের স্বভাব এবং সক্ষমতা দম্ভের কাছে সর্বদা মাথানত কর। তোমরা সুযোগ পেলে দম্ভ দেখাও এবং অত্যাচার কর। আর কেউ যদি রুখে দাঁড়ায় তবে ওরে বাবাগো- ওরে মাগো বলে ভাগো। তোমাদের মধ্যে যারা সাহসী যারা বীর তাদের বিপদের সময় ভালোবাসো এবং বিপদ কেটে গেলে ওসব লোককে কাপুরুষ বানিয়ে তাদের অপদস্থ করতে তোমাদের বুক কাঁপে না। কাজেই আমার সন্তান অর্থাৎ গায়েবি মামলার ভয় ছাড়া তোমাদের কাবু করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার।
তোমরা যেহেতু আমার সন্তানকে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভয় পেয়ে আসছ সুতরাং তোমাদের সম্মান বা সমীহ করার কোনো কারণ
নেই। আমি নেহায়েত ভদ্রজন বলে তোমাদের তুমি বলে সম্বোধন করছি। আমার পরিবর্তে অন্য কেউ হলে সে তোমাদের স্বভাবের কারণে তুমির পরিবর্তে তুই-তোকারি করত এবং প্রকৃতির নিকৃষ্ট প্রাণের সঙ্গে তুলনা করে তোমাদের গালিগালাজ করত। দ্বিতীয়ত তোমরা যেহেতু আমার সন্তানের ভয়ে বছরের পর বছর ধরে কেঁপেছ, এক গর্ত থেকে অন্য গর্তে পালিয়েছ এবং গভীর রাতে প্রিয়জনের বাহুলগ্ন হয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জীববিদ্যার সূত্রকে বিফল এবং শারীরিক রসায়নকে ব্যর্থ করে দিয়েছ, সুতরাং আমি মুরব্বি হিসেবে তোমাদের সংগত কারণেই তুমি বলে সম্বোধন করতে পারি।
আত্মকথনের এই পর্যায়ে আমি এখন নিজের কথা বলব। তোমরা আমাকে গাণিতিক মামলা হিসেবে ডাকতে পার। যদিও আমি আমার পরিচয় ইংরেজিতে দিতেই পছন্দ করি। নিজেকে যদি আমি ম্যাট্রিকুলাস কেইস হিসেবে পরিচয় দিই তবে সেটার মধ্যে অনেক আভিজাত্য ফুটে ওঠে। অধিকন্তু ম্যাট্রিকুলাস দ্বারা গণনা বা ক্যালকুলাস যেমন বোঝায় তদ্রƒপ ম্যাথমেটিকস বা অঙ্কশাস্ত্রকেও বোঝানো যেতে পারে। অন্যদিকে অঙ্কশাস্ত্রের অধীন পাটিগণিত, বীজগণিত, উচ্চতর গণিত, জ্যামিতি-ত্রিকোনোমিতি ও পরিসংখ্যানতত্ত্বও বোঝানো হতে পারে। কাজেই বাংলায় যদি গাণিতিক মামলা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিই তবে আমার পরিচয় শুধু গায়েবি মামলার আব্বা। অন্যদিকে নিজেকে যদি ম্যাট্রিকুলাস কেইস হিসেবে পরিচয় দিই তবে আমার উচ্চতা এবং গুরুত্ব ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, চীনের গ্রেট ওয়াল, মিসরের পিরামিড, আগ্রার তাজমহল কিংবা আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। কারণ ওগুলো সবই ম্যাট্রিকুলাস সূত্র অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে।
তোমরা আমাকে সুবে বাংলার গায়েবি মামলার আব্বা গাণিতিক মামলা মনে করবে নাকি ইউরোপ-আমেরিকার আদলে ম্যাট্রিকুলাস কেইস মনে করবে, সেটা তোমাদের বিষয়। কিন্তু আমি যা করার ইতোমধ্যে করে ফেলেছি। তোমাদের অনেকের আব্বার নাম ভুলিয়ে দিয়েছি। অনেকের আব্বার সর্বাঙ্গ ভেঙেচুরে, জ্বালিয়েপুড়িয়ে মস্তিষ্কের খুলিতে আবর্জনা ঢেলেছি। তারপর আমার সন্তানের বদখাসলতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এমন সব মামলা-মোকদ্দমা করেছি যা প্রচলিত পাটিগণিত ও বীজগণিতের সব সূত্রকে কবর দিয়ে তোমাদের জন্য নতুন সূত্র পয়দা করে দিয়েছি। ফলে দুনিয়ায় বসে তোমরা সেভাবে জাহান্নামের স্বাদ পাচ্ছ তদ্রƒপ তোমাদের অতীতের পালানোর প্রবৃত্তি বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়ে এখন এমন এক রেকর্ড তৈরি করেছে, যা দেশবিদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়েছে।
আমার কারণে মহাকালের সবচেয়ে বড় বাস্তচ্যুতি ঘটেছে। মামলা-হামলার ভয়ে কয়েক কোটি লোক দেশের অভ্যন্তরে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক শহর থেকে অন্য শহর এবং এক পেশা থেকে অন্য পেশায় যেভাবে নিজেদের যাযাবর বানিয়ে ফেলেছে, তা হিসাব করার জন্য স্যার আইজাক নিউটনের মতো অঙ্কবিদের প্রয়োজন হবে। আমার কুলাঙ্গার সন্তানকে যারা অভিশাপ দিত এবং স্বপ্নেও যারা আমার ক্ষমতা, শয়তানি শক্তি এবং কৌশল সম্পর্কে ভাবতে না, তাদের জন্য আমি যে কত বড় অভিশাপ হিসেবে এসেছি, তা যদি বুঝতে চাও তবে থানা ও কোর্টকাচারিতে বিগত দিনে কয়টি গাণিতিক মামলা হয়েছে তা একটু জেনে আস এবং সেসব মামলার ক্ষয়ক্ষতির গতিপ্রকৃতি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া গণনা করার জন্য মস্ত বড় একখানা ক্যালকুলেটর জোগাড় কর। তারপর আগামী ১০ বছর শুধু হিসাব করতে থাক- কী হলো, কেন হলো, কারা করল, কেন করল এবং কীভাবে করল।
অতীতের গায়েবি মামলা বনাম বর্তমানের গাণিতিক মামলা অর্থাৎ আমার সন্তান ও আমার মধ্যে যদি পার্থক্য করতে চাও তবে জেনে নাও, আমার সন্তান শব্দ করত আর আমি নীরবে কাম সারি। আমার সন্তানকে ব্যবহার করে কেবল থানা-পুলিশ-কোর্টকাচারি-উকিল মোক্তার নড়াচড়া করত। আর আমার কারণে সারা দুনিয়া নড়াচড়া করে। গায়েবি মামলা আগে দায়ের হতো, তারপর ঘটনা ঘটানো হতো, এরপর বাণিজ্য চলত।
এখন পুরো সিস্টেম উল্টে গেছে। প্রথমে বাণিজ্য হয়, তারপর ঘটনা ঘটে এবং সবার শেষে মামলা হয়। আমার সন্তানকে ব্যবহার করা হতো- পটকা ফোটানো, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মিথ্যা নাটক সাজিয়ে চুনোপুঁটি-সরপুঁটি থেকে শুরু করে রুই-কাতলাদের দৌড়ের ওপর রাখার জন্য। আর আমি অতীতের ওসব প্যানপ্যানানি বাদ দিয়ে ডাইরেক্ট কেল্লাফতে সূত্র অনুসরণ করে সরাসরি ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেতুবন্ধন তৈরি করে চলেছি।
তোমরা যারা আমাকে নিয়ে গর্ব করছ- আমার কারণে পোলাও-কোর্মা, কালিয়া-কোপ্তা খাচ্ছ আর আরাম কেদারায় দোল খেতে খেতে যাত্রাদলের ভিলেনের মতো মুহাহা মুহাহা শব্দে হাসার চেষ্টা করছ তাদের উদ্দেশে আমার অন্তিম বাণী আমি হয়তো বেশি দিন টিকব না। আবার সন্তানের মতো আমিও হয়তো শিগগিরই হারিয়ে যাব। সুতরাং তোমরা অনতিবিলম্বে মুহাহা মুহাহা ধ্বনি বন্ধ কর, অন্যথায় ঊর্ধ্বলোক থেকে আবার আব্বাহুজুর তোমাদের উদ্দেশে রওনা দেবেন।