জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ও এক্সে প্রচার না করতে আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে এসব মাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্য অতিদ্রুত সরাতেও বলা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপক্ষের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে এ আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্য হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অতিদ্রুত এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের আবেদন ট্রাইব্যুনাল শুনেছেন এবং মঞ্জুর করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিয়েছেন যে যেসব হেট স্পিচ (বিদ্বেষমূলক বক্তব্য) এখনো আছে, সেগুলো যেন অতিদ্রুত রিমুভ (সরানো) হয়।’
আদালতের আদেশের কথা উল্লেখ করে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের অধীনে যে মামলাগুলো তদন্ত অবস্থায় আছে, তদন্তকালে কোনো আসামি এমন কোনো হেট স্পিচ (বিদ্বেষমূলক বক্তব্য) দিতে পারবেন না, যাতে এই মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়।’
শেখ হাসিনার বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের উদাহরণ টেনে মোনাওয়ার হোসেন বলেন, ‘আপনারা ইতিমধ্যে দেখেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে (সম্প্রচারমাধ্যম) মামলার একজন আসামি শেখ হাসিনার কিছু কিছু বক্তব্য ও ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। সেখানে তিনি (শেখ হাসিনা) কিছু বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন ২২৭টি মামলা হয়েছে (শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে)। অতএব তিনি ২২৭ জনকে হত্যার সার্টিফিকেট পেয়ে গেছেন, লাইসেন্স পেয়ে গেছেন। তিনি (শেখ হাসিনা) আরও বলেছেন, তোমাদের বাড়িঘর পোড়াচ্ছে, তাঁদের বাড়িঘর নেই। এই শব্দগুলো দিয়ে এই মামলার ভিকটিমকে (ভুক্তভোগী) একধরনের থ্রেড (হুমকি) দেওয়া হয়েছে।’
এ ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের কারণে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ভয় পাবেন উল্লেখ করে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন বলেন, ‘যেসব সাক্ষী এসব মামলায় (জুলাই-আগস্টের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা) জবানবন্দি দিয়েছেন, তাঁদের কিন্তু ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষী দিতে হবে। এখন এ ধরনের বক্তব্য (শেখ হাসিনার বক্তব্য) পাবলিশড (প্রকাশিত) হয়, ব্রডকাস্ট (সম্প্রচার) হয়, তাহলে আমরা ট্রায়ালের সময় (বিচারকাজ চলাকালে) সাক্ষীদের আনতে পারব না। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি ফৌজদারি অপরাধ উল্লেখ করে এই প্রসিকিউটর বলেন, ‘হেট স্পিচ (বিদ্বেষমূলক বক্তব্য) এমন একটি অপরাধ, যা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে সব আইনে, সব জায়গায় একটি ক্রিমিনাল অফেনস। এ কারণে যেটি করা হচ্ছে (বিদ্বেষমূলক বক্তব্য) এবং সেটি ভবিষ্যতে পাবলিশ (প্রকাশ) বন্ধের জন্য এবং ইতিপূর্বে যেসব হেট স্পিচগুলো সোশ্যাল মিডিয়া (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় (সম্প্রচারমাধ্যম) আসছে, সেগুলো রিমুভের (সরানো) জন্য আবেদন করেছিলাম। এসব হেট স্পিচ এখনো বিদ্যমান এবং সেগুলো রিমুভ করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের হেট স্পিচ পাবলিশ না হয়, সে জন্য ট্রাইব্যুনাল আদেশ দিয়েছেন।’
গাজী মোনাওয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা আবেদনটি করেছিলাম একজন আসামির হেট স্পিচের বিষয়ে, তিনি হলেন শেখ হাসিনা। কারণ, এখন পর্যন্ত শুধু ওনার হেট স্পিচগুলো আমাদের কাছে আছে, যেগুলোর প্রমাণ পেয়েছি। এগুলো তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করে। শুধু হেট স্পিচ বন্ধের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল, এর বাইরে যদি কোনো সাধারণ বক্তব্য থাকে, সেটি সম্প্রচার করা যাবে।’
‘শেখ হাসিনার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী’
শেখ হাসিনার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পরিপন্থী উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আরেক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটসের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী এগুলো (শেখ হাসিনার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য) বিদ্বেষমূলক চর্চা এবং ঘৃণার চর্চা। এগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন যেগুলো আছে, শেখ হাসিনার বক্তব্য সেগুলো কাভার করে না। শেখ হাসিনার বক্তব্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এই মন্তব্যগুলো ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, সেটি আমরা লিখিতভাবে ফেসবুক, টুইটার (এক্স), ইউটিউবসহ ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মে যেসব সোশ্যাল মিডিয়া আছে, সেখানে আমরা আমাদের ট্রাইব্যুনালের আদেশটা পৌঁছাব, লিখিতভাবে জানাব।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান। এরপর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও দলের নেতার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে হত্যার অভিযোগ জমা পড়েছে।