সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার পর থেকে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে, সাথে সাথে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্কও বিরাজ করছে। সরকার, রাজনৈতিক দল ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রশ্ন তুলছে—কীভাবে সচিবালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এত বড় ঘটনা ঘটল? এটি কি কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং দায়িত্বশীল অন্যান্য কর্তারা তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার আগে আগুনের কারণ নিয়ে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান বলেন, এটা স্যাবোটাজ (নাশকতামূলক) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আগুনটা শর্ট সার্কিট থেকে হলে একসঙ্গে ৩-৪ জায়গায় লাগার কথা নয়। দুর্বৃত্তদের লাগানো আগুনেই এমনটা হয়।
তিনি বলেন, আমি ভোর রাত থেকে এই আগুন ফলো করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা স্যাবোটাজ। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে এটা লাগানো আগুন, শর্ট সার্কিটের আগুন কখনো এভাবে লাগে না। এর মধ্যে কাল তো সচিবালয় বন্ধ ছিল। সুতরাং সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়ে যাচ্ছে।
তিনি জানান, সচিবালয় রাষ্ট্রের ‘কি’ পয়েন্ট এবং কেপিআইভুক্ত এলাকা। যদিও এখানে আগেও একাধিকবার আগুন লেগেছে এবং পিডব্লিউ কাজও করেছে। তবুও কেন আবার আগুন লাগল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা হয়েছে, এভাবে কখনো দুর্ঘটনার আগুন লাগে না।
এক গার্মেন্টসে লাগা আগুনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, দুর্বৃত্তরা যখন আগুন লাগায় তখন একসঙ্গে একাধিক স্থানে আগুন লাগে। এমন দুর্বৃত্তায়নের আগুন আমি আগেও দেখেছি। এখানেও (সচিবালয়) তাই হয়েছে। এটা শর্ট সার্কিট না, আগুন লাগানো হয়েছে।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আগুন লাগাটা একদম গ্রহণযোগ্য নয়, এমন মন্তব্য করে ফায়ার বিশেষজ্ঞ বলেন, এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এখানে গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি বা স্যাবোটাজ হতে পারে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল এবং নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা পালন করা প্রয়োজন। পুলিশ কতক্ষণ থাকবে, তার চেয়ে নিরাপত্তা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে।
সচিবালয়ের আগুনকে সরাসরি নাশকতার অংশ হিসেবে দেখছেন ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর তদন্তে দেখতে হবে, সেখানে লোকজন ছিল কি-না, ফায়ার প্লান্ট কাজ করেছে কিনা, এবং মশার কয়েল বা সিগারেট ছিল কি-না। এছাড়া, যদি মানুষ না থাকে, তবে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকার কথা। এসব বিবেচনা করে তদন্ত করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ডিজি আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, আগুন যদি ছয় তলাতে হয়। সেটা কিন্তু রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমেও কোনো কিছু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে করা হতে পারে। ড্রোন ব্যবহার কিংবা মানুষ ঢুকছিল কি না সেটার আলামত খুঁজতে হবে। এটা স্যাবোটাজ না এমন ভাবার কোনো কারণ নেই।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক এই ডিজি বলেন, যে সব কার্যালয়ে আগুন লেগেছে, সেখানে ডানে-বায়ে কীভাবে ভবনের প্রান্তে চলে যায়? আবার নিচেও আগুন দুই কোনায় পৌঁছে যাওয়া অবিশ্বাস্য। এখানে বারুদের ব্যবহার হতে পারে। সেটা তদন্তে খুঁজতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (অপারেশনস) মেজর (অব.) একেএম শাকিল নেওয়াজ বলেন, সচিবালয়ে লাগা আগুন নির্বাপনে ১০ ঘণ্টা সময় নেওয়া অবিশ্বাস্য।
সচিবালয়ে আগুন লাগানো হয়েছে বলে দাবি করে তিনি বলেন, নাশকতার যথেষ্ট কারণ আছে। যে-সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ সে সব জায়গাতে আগুন লাগছে। আরেক ভবনে তো আগুনই লাগেনি।
তিনি বলেন, যদি আগুনটি দুর্ঘটনাজনিত হতো, তাহলে তা এক জায়গায় লাগার কথা। কিন্তু এখানে একসঙ্গে তিনটি জায়গায় আগুন লাগল, যা সন্দেহজনক। তিনি প্রশ্ন করেন, যেখানে পুলিশ, আনসার ও বিজিবি ছিল, সেখানে চারপাশের লাইট বন্ধ ছিল কেন? ফায়ার সার্ভিস কী করছিল? তাদের কী ধরনের দুর্বলতা ছিল? তিনি উল্লেখ করেন, বঙ্গবাজারের ১০ গজের মধ্যে আগুন দ্রুত নেভাতে পারল না ফায়ার সার্ভিস, আর সচিবালয়ের মতো কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠানে তাও সম্ভব হলো না। এটি অগ্রহণযোগ্য এবং তাদের ব্যর্থতাকেও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
সচিবালয়ে লাগা আগুনের ঘটনায় উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন নিয়ে সমালোচনা করে তিনি বলেন, কমিটিতে রাখা ব্যক্তিরা অভিজ্ঞতা ছাড়াই কীভাবে আগুনের কারণ বা স্যাবোটাজ শনাক্ত করবেন? যেখানে ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে তাদেরই আবার কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, তদন্ত কমিটিতে র্যাব-পুলিশের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের সাবেক ও বিশেষজ্ঞদের রাখা উচিত ছিল। সূত্র : ঢাকা পোস্ট