আহমদ ছফা ছিলেন মুক্তমন ও চিন্তার অধিকারী নির্ভীক মানুষ। তিনি নির্মোহভাবে সত্য কথা বলতে পেরেছেন। তরুণ প্রজন্মের উচিত তাঁর চিন্তাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে মেধা, মনন ও ইতিহাসের চর্চা করা। আজ শনিবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমেশচন্দ্র মজুমদার মিলনাতনে আলোচনায় বক্তারা এই মন্তব্য করেছেন।
বিশিষ্ট লেখক ও সমাজচিন্তক আহমদ ছফার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা স্মৃতিবক্তৃতা ও গ্রন্থ প্রকাশনার আয়োজন করা হয়। ‘আহমদ ছফার চলচ্চিত্রায়ণ’ শীর্ষক স্মৃতিবক্তৃতা দেন তরুণ কবি ও চলচ্চিত্র–গবেষক সৈকত দে। সভাপতিত্ব করেন কবি মোহন রায়হান।
অনুষ্ঠানে আহমদ ছফার বহুল আলোচিত প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ এবং এই প্রবন্ধ নিয়ে যেসব সমালোচনা হয়েছিল, আহমদ ছফা যে জবাব লিখেছিলেন, সেসবের বিশ্লেষণ করে লেখা প্রবন্ধ নিয়ে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের ‘আ মরি আহমদ ছফা’ বইটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
আলোচনায় অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন, ২০০১ সালের ২৭ জুলাই আহমদ ছফার মৃত্যুর পর থেকে এই দিনটির কাছাকাছি সময়ে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়ে থাকে। এবারও প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু জুলাই–আগস্টে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে যে বিপুল ছাত্র গণ-আন্দোলন হলো, সে কারণে অনুষ্ঠান করা যায়নি। এখন একটু বিলম্বে আহমদ ছফাকে স্মরণ করে এই অনুষ্ঠান হচ্ছে।
সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের অনেক ঘটনার তাৎপর্যের পরিবর্তন ঘটে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে তেমনি এক পরিবর্তন আমরা লক্ষ করেছি। এই আন্দোলনে ছাত্র–জনতা একটিও গুলি ছোড়েনি। “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে গুলি করেছে আওয়ামী লীগের অনুগত ছাত্রলীগ, যুবলীগ আর পুলিশ। অথচ একটা সময় এই “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছেন, শত্রুর দিকে গুলি ছুড়েছেন। স্লোগানটির দোষ নেই, তবে সময়ের সঙ্গে তার তাৎপর্য বদলে গেছে। এ কারণেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের তাৎপর্য মিলিয়ে সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।’
সলিমুল্লাহ খান আরও বলেন, সম্প্রতি বিখ্যাত পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্টে ২০২৪ সালে পৃথিবীর সেরা ঘটনাগুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের উৎখাতের ঘটনাটি। ভারতের গণমাধ্যম এই অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যাপক সহিংসতার যে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আসছে, ইকোনমিস্টের এই রিপোর্ট তাদের গালে একটি চপেটাঘাততুল্য হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে সৈকত দে বলেন, আহমদ ছফার গল্প ও উপন্যাস নিয়ে এ পর্যন্ত তিনটি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘ওঙ্কার’ অবলম্বনে আবু সায়ীদ নির্মিত টিভি নাটকটি সবচেয়ে উজ্জ্বল।
‘বাংলা’ নামে শহীদুল ইসলাম খোকন নির্মিত চলচ্চিত্র বাণিজ্যিক ঘরানার হলেও তিনি মূল রচনা থেকে সরে যাননি। কিন্তু ‘অলাতচক্র’ নিয়ে হাবিবুর রহমানের চলচ্চিত্রটিতে মূল কাহিনি থেকে সরে গিয়ে আহমদ ছফা যা বলেননি তাই বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সাহিত্যনির্ভর অধিকাংশ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নির্মাতারা মূল কাহিনির বিষয়বস্তু থেকে সরে গিয়ে তাঁদের মর্জিমাফিক অনেক বক্তব্যের অবতারণা করেন, যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।’
অনুষ্ঠানে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র ও দৃশ্যশিল্পের অধ্যাপক নাঈম মোহাইমেন বলেন, ‘আহমদ ছফার একটি দূরদৃষ্টি ছিল। তিনি অনেক আগে থেকেই সমাজ-রাজনীতির বিবর্তন অনুধাবন করতে পারতেন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সেসব পর্যবেক্ষণ তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। কোনো লাভ–ক্ষতির বিষয় বা কোনো ভয়ভীতি তাঁকে তাঁর উপলব্ধির প্রকাশ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এ কারণে তাঁর চিন্তা এই সময়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।’
শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা লুৎফা হাসিন বলেন, আহমদ ছফা শুধু নিজে বিপুল প্রতিভাধর ছিলেন না, তিনি তরুণ প্রতিভাবানদেরও চিনে নিতে পারতেন। সেইসব তরুণ প্রতিভার বিকাশে নিঃস্বার্থভাবে সহায়তা দিয়েছেন। আহমদ ছফার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের স্মৃতিচারণা করেন।
সভাপতির বক্তব্যে কবি মোহন রায়হান বলেন, আহমদ ছফা ইতিহাসের ঘটনার ভেতরে অবস্থান করে তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। অন্যদের মতো মনের মাধুরী মিশিয়ে ইতিহাস লেখেননি। ফলে তাঁর লেখাগুলো দেশের সমাজ–রাজনীতির ইতিহাসের প্রামাণ্য সূত্র হয়ে আছে। তিনি শুধু নিজে বাঁচতে চাননি, সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। একটি মুক্ত সমাজের জন্য যেমন লেখালেখি করে গেছেন, তেমনি একইভাবে মাঠেও আন্দোলন–সংগ্রামে সক্রিয় থেকেছেন। তাঁর কোনো তুলনা হয় না।