বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে অনেক মানুষ গুম হয়েছে। গুমের ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকার যে কমিশন গঠন করেছে, তাদের কাছে গুমের অভিযোগ এসেছে ১ হাজার ৬৭৬টি। প্রাথমিকভাবে এর মধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগ পর্যালোচনা করেছে কমিশন।
এই ১৬ বছরে সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে ২০১৬ সালে, ১৩০টি। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ৫, ২০১০ সালে ১৯, ২০১১ সালে ২৩, ২০১২ সালে ৩৬, ২০১৩ সালে ৭৩, ২০১৪ সালে ৪৫, ২০১৫ সালে ৭৮, ২০১৭ সালে ৮৪, ২০১৮ সালে ৮৯, ২০১৯ সালে ৩৬, ২০২০ সালে ১৮, ২০২১ সালে ২৫, ২০২২ সালে ৪২, ২০২৩ সালে ৩৪ ও ২০২৪ সালে ২১টি গুমের অভিযোগ এসেছে।
গুমের শিকার ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গুমের বেশির ভাগ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল র্যাব, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই।
গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গুম সংস্কৃতি’ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে ঘুণাক্ষরেও কেউ কিছু বুঝতে না পারে। উদাহরণ হিসেবে সাদাপোশাকে নিরাপত্তা বাহিনীর তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। নিজেদের বদলে অন্য সংস্থার পরিচয় দেওয়া হতো। যেমন ডিজিএফআই হলে র্যাবের পরিচয় দেওয়া হতো, আর র্যাব হলে পরিচয় দিত গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)। একটি বাহিনী তুলে নিয়ে আসার পর অন্য বাহিনীর কাছেও বন্দী থাকত। এরপর হত্যা বা মুক্তি দিত তৃতীয় কোনো বাহিনী।
গুমের শিকার এক ব্যক্তির কল রেকর্ড থেকে দেখা যায়, তাঁকে তুলে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই তাঁর মুঠোফোনের প্রথম অবস্থান শনাক্ত হয় ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরে। এরপর তাঁকে নেওয়া হয় ঢাকায় র্যাবের একাধিক আটক কেন্দ্রে। কয়েক মাস পর তাঁকে চট্টগ্রামে র্যাব-৭–এর গ্রেপ্তারের কথা জানানো হয়। এতে বোঝা যায়, গুমের শিকার কোনো ব্যক্তিকে জীবিত পাওয়া গেলেও তাঁকে কোন বাহিনী তুলে নিয়েছিল, তা বোঝা খুব কঠিন।
এসব কারণে গুমের শিকার ব্যক্তিকে হত্যায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁরাও জানতেন না কাকে তাঁরা হত্যা করছেন অথবা এই হত্যার কারণ কী, কেনই–বা এই হত্যাকাণ্ড ঘটছে। বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করেছেন যে এসব তথ্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গোপন রাখতেন। এর মাধ্যমে কখনো যাতে নেতৃস্থানীয় কাউকে তদন্তের মুখোমুখি হতে না হয় এবং দায়ীদের বিচার করা না যায়, সে বন্দোবস্ত করা হতো।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুলে নেওয়ার পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে হাতবদল, এক বাহিনীর এলাকায় অন্য বাহিনীর তৎপরতা ও এসব তৎপরতার নির্দিষ্ট কোনো একটি সীমানা না থাকায় গুমের ঘটনাগুলোর তদন্ত জটিল করে তুলেছে।
‘টার্গেট’ নির্ধারণ হতো যেভাবে
গুমসংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাকে গুম করা হবে, এটা কীভাবে নির্ধারণ করা হতো, সে বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর মতো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এখনো কমিশন পায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে টার্গেট নির্ধারণের দুটি পদ্ধতির বিষয় উঠে এসেছে।
প্রথমটি একটি নেটওয়ার্কভিত্তিক পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে বন্দীদের নির্যাতন করে অন্যদের নাম বলতে বাধ্য করা হতো। এরপর যাঁদের নাম আসত, তাঁদের তুলে আনা হতো। তুলে এনে নির্যাতন করে তাঁদেরও নাম বলতে বাধ্য করা হতো। এর মাধ্যমে দীর্ঘ হতো গুম করা ব্যক্তিদের তালিকা।
এ ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিদেরও গুমের শিকার হতে হয়েছে। এমন অনেক ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেখানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নাম বলতে বাধ্য করে নিরপরাধ ব্যক্তিদের তুলে আনা হয়েছে। নাম বলতে বাধ্য হয়েছিলেন এমন একজন ব্যক্তি জানান, তিনি বাধ্য হয়ে এমন ব্যক্তিদের নাম বলেছিলেন,
যাঁরা ছিলেন নিরপরাধ। তিনি ভেবেছিলেন, অপরাধী না হওয়ায় এসব ব্যক্তির হয়তো কিছু হবে না। কিন্তু পরে তিনি শুনেছেন, তিনি যাঁদের নাম বলেছিলেন, তাঁদের একজনকে গুম করা হয়। এটা নিয়ে অনুতাপের কথা জানান তিনি।
দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশ। এরও প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত র্যাব ১১-এর তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার তারেক সাইদ মোহাম্মদ ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছিলেন, সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য তাঁকে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) জিয়াউল আহসান।
গুমের শিকার হওয়ার পর যখন ছেড়ে দেওয়া হয়, সেই সময় কী বলা হয়েছিল, তাঁর স্মৃতিচারণা করেছেন হুম্মাম কাদের চৌধুরী। ছেড়ে দেওয়ার সময় তাঁকে বলা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আছে। আপনি রাজনীতি করতে পারবেন না। দেশ ছেড়ে যেতে হবে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে দেশে ফিরতে পারবেন। মনে রাখবেন প্রধানমন্ত্রী আপনাকে জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ঘটনা থেকে গুমের পদ্ধতির বিষয়ে কিছু কিছু ধারণা পাওয়া গেলেও এ বিষয়ে একটি জোরালো উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য আরও তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। এ নিয়ে আরও তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কমিশন।
যেভাবে করা হতো নজরদারি
গুমের শিকার ব্যক্তি ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কমিশন জানতে পেরেছে, গুমের ক্ষেত্রে নজরদারির প্রধান হাতিয়ার ছিল মুঠোফোন প্রযুক্তি। কমিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে র্যাব ও সামরিক কর্মকর্তারা এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে টার্গেট করা ব্যক্তির অবস্থান নিখুঁতভাবে শনাক্ত করার কাজ মুঠোফোনে নজরদারি করা ছাড়া অসম্ভব।
ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নামে একটি স্বাধীন নজরদারি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করার আগে এর পূর্বসূরি ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টারের (এনএমসি) মাধ্যমে নজরদারি করা হতো। এর অবস্থান ছিল ডিজিএফআই সদর দপ্তরে।
শুধু নজরদারির কাজে ব্যবহৃত প্রযুক্তি-পদ্ধতি র্যাব ও ডিবির মতো অন্য বাহিনীর কাছে সরবরাহ করত ডিজিএফআই। ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টারে নজরদারি প্রযুক্তি পরিচালনা করতে বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের রাখা হতো। তাঁরা পালা করে এ দায়িত্ব পালন করতেন। ডিজিএফআইয়ের সাবেক একজন মহাপরিচালক (ডিজি) কমিশনকে বলেন, নজরদারির জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে কারিগরি সহযোগিতা দিত ডিজিএফআই।
এসব ঘটনা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সমন্বিতভাবে গুমের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরছে। এনটিএমসি প্রতিষ্ঠার পর নজরদারির তৎপরতাগুলো স্বাধীন এই সংস্থার একক কর্তৃত্বে চলে আসে। তবে প্রাথমিক কিছু প্রতিবেদন থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে নজরদারি করার কিছু ক্ষমতা এখনো নির্দিষ্ট বাহিনীর কাছে রয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এর অন্যতম কারণ, এই সংস্থাগুলোর নজরদারি করার আইনি ক্ষমতা নেই।
আইনি ক্ষমতা না থাকার পরও গুমের শিকার বেশ কিছু ব্যক্তির কথায় জানা গেছে, ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে থেকেই তাঁদের ওপর নজরদারি চলত। উদাহরণ হিসেবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। একজন জানান, স্ত্রীর দাঁতের চিকিৎসা নিয়ে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে কথোপকথনের বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারেন, ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে থেকে তাঁর ওপর নজরদারি চলছিল। গুমের শিকার আরও একাধিক ব্যক্তি জানান, ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁদের মুঠোফোনে সন্দেহজনক কল আসে। কল আসত কিন্তু অপর প্রান্তে কেউ কথা বলত না।
টার্গেট করা ব্যক্তিদের অবস্থান নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করার জন্যই এ ধরনের কল করা হতো। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে একটি কক্ষে ঢুকেছিলেন। কক্ষে ঢুকে তাঁরা সেখানে থাকা সবার মুঠোফোন সারিবদ্ধভাবে রাখার নির্দেশ দেন। এরপর একটি মুঠোফোনে কল আসে। তখন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা জানতে চান, ফোনটি কার? ফোনের মালিক কে শোনার পর তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।