পুলিশকে জনবান্ধব ও মানবিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে ‘পুলিশ কমিশন’ গঠন এবং ‘র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিলুপ্তি চেয়ে এ–সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাব ও সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে পুলিশ বিভাগের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নানা অসংগতি ও অনিয়ম দূর হবে বলে মনে করে দলটি।
আজ মঙ্গলবার সকালে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিটির প্রধান ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ সুপারিশমালা তুলে ধরেন।
হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পুলিশকে বাদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্র বা সমাজ কল্পনা করা কাম্য নয়। সুতরাং প্রায় গণশত্রুতে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও এই বাহিনীকে ছেঁটে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। এটিকে সংশোধন করে আবার দাঁড় করাতে হবে। পতিত সরকারের আমলে বাংলাদেশ একটা পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। এই পুলিশ বাহিনী যাতে জনগণের প্রতি সংবেদনশীল হয়, তাদের মগজে যেন এই ধারণাটি প্রথিত হয় যে দেশের মালিক জনগণ…তারা জনগণের প্রভু নয়, সেবক। এই ধারণাটি তাদের মনে ঢোকাতে আমরা বিভিন্ন সুপারিশ করেছি।’
হাফিজ বলেন, এর একটি হচ্ছে, ‘তাদেরকে (পুলিশ বাহিনী) ক্লোজড মনিটরিংয়ের (নিবিড় পর্যবেক্ষণ) জন্য পুলিশ কমিশন থাকবে…এই কমিশন ওয়াচ ডক হিসেবে কাজ করবে। উপজেলা পর্যায়ে নাগরিক কমিটি থাকবে, সেখানে স্থানীয় জনগণ মিলে পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখবে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে। সর্বশেষে গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের জন্য আমরা সুপারিশ করেছি।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘পুলিশ বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতপূর্বক মানবাধিকারের প্রতি আরও সচেতন করা এবং দক্ষ করে এই বাহিনীকে দুর্নীতিমুক্ত করে গড়ে তুলতে আমরা বিভিন্ন সুপারিশ তৈরি করেছি, যা পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনকেও দিয়েছি। শুধু উন্নতর সেবা প্রাপ্তির জন্য নয়, ভবিষ্যতে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক নিষ্ঠুর আচরণের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সেই লক্ষ্যে পুলিশ বিভাগের সংস্কার জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে।’
‘র্যাব বিলুপ্তি চায় বিএনপি’
র্যাবের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য এই বাহিনীকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে বিএনপি। ২০০৪ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে পুলিশের এই বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়। বিএনপির আমলে গঠিত এই বাহিনীকে সংস্কার না করে কেন বিলুপ্ত করতে চায়, প্রশ্ন করা হলে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, এটা মেডিকেল বিদ্যাতেও আছে, যখন একেবারে গ্যাংরিন হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, তখন কেটে ফেলা
ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
হাফিজ বলেন, ‘সে জন্য আমরা মনে করেছি, র্যাব আন্তর্জাতিকভাবেই এমনভাবে নিন্দিত হয়েছে…আর দেশে তো র্যাব মানেই একটা দানব তৈরি করা হয়েছে। তারা যত ধরনের খুন-গুম, যত এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং (বিচারবহির্ভূত হত্যা), অধিকাংশই এই র্যাব বাহিনীর মাধ্যমে হয়েছে। সে জন্য আমরা এটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছি। র্যাব বিলুপ্ত হলে র্যাবের দায়িত্ব আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং থানা-পুলিশ যেন পালন করতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
এই মুহূর্তে র্যাবকে বিলুপ্ত করা হলে জনগণের কাছে একটা ভালো সিগন্যাল যাবে বলে মনে করেন হাফিজ। বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—
পুলিশ কমিশনের কার্যপরিধি
কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন সংসদ থাকলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান। সংসদ না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। আট সদস্যের এই কমিশনে সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চ আদালতের আইনজীবী, সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক এবং স্বরাষ্ট্রসচিব মনোনীত অতিরিক্ত সচিব। আইজিপির মনোনীত একজন অতিরিক্ত আইজি এই কমিশনের সদস্যসচিব হিসেবে কাজ করবেন। সরকারি বিধিবিধান দ্বারা এই কমিশনের সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি, কাজের পরিধি ও কর্মকাল নির্ধারণ করা হবে।
নাগরিক কমিটি
স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশকে অপরাধ দমনে সহায়তা প্রদান, জনসাধারণ-পুলিশ সম্পর্ক উন্নয়নে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পরামর্শ দিতে প্রতিটি উপজেলা/থানায় একটি নাগরিক কমিটি গঠন করা হবে। স্থানীয় গণ্যমান্য, সুশিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হবে।
এই কমিটির সভাপতি হবেন একজন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি। সদস্যসচিব হবেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এ ছাড়া দুজন ইউপি সদস্য, একজন শিক্ষক, একজন ব্যবসায়ী, একজন পেশ ইমাম এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রতিনিধি কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করে দুই বছর মেয়াদের জন্য এই নাগরিক কমিটিতে কাজ করবেন।
কমিউনিটি পুলিশিং
এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে অপরাধ দমন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সামাজিক সমস্যাদি সমাধানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সমাজে বিবিধ অপরাধপ্রবণতা এবং সামাজিক অস্থিরতা কমবে, পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যে দূরত্ব কমবে, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং আইনের শাসন জোরালো হবে।
গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি ইউনিয়নে এবং শহরাঞ্চলে প্রতিটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে একজন অবসরপ্রাপ্ত কমিউনিটি পুলিশ কর্মকর্তা (সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিচে নয়) নিয়োজিত হবেন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাঁর একটি অস্থায়ী দপ্তর থাকবে। পুলিশ কর্মকর্তা এলাকার জনপ্রতিনিধি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, ইমাম, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, নারীসমাজ, কৃষক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করবেন। কমিউনিটি পুলিশ অফিসারের বেতন-ভাতা সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ বহন করবে।
প্রতিবছর পুলিশ সদস্যদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল এবং প্রতিটি জেলায় পূর্ণাঙ্গ পুলিশ হাসপাতালসহ বিভাগ ও মেট্রোপলিটন শহরে ঢাকার রাজারবাগ কেন্দ্রীয় হাসপাতালের মতো পুলিশ হাসপাতাল নির্মাণের সুপারিশ করেছে বিএনপি।
সংবাদ সম্মেলনে সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব এস এম জহিরুল ইসলাম, সাবেক আইজিপি আবদুল কাইয়ুম, আশরাফুল হুদা, সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাঈদ হাসান খান ও আনসার উদ্দিন খান পাঠান উপস্থিত ছিলেন।
৫ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেনের কাছে বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে বিএনপি।