একটি মিথ্যা মামলা থেকে চূড়ান্তভাবে রেহাই পেতে কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুর গ্রামের বাসিন্দা হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রের লাগলো ৩৬ বছর। তিন যুগের আইনি লড়িইয়ে হরেন্দ্রনাথ কেবল রেহাই-ই পাননি, মামলার খরচ হিসেবে তাঁকে ২০ লক্ষ টাকা দিতে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। আদেশের অনুলিপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে বৃদ্ধ হরেন্দ্রনাথকে এই ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে অবেদন) খারিজ করে সোমবার এই রায় দেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।
আদালতে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের পক্ষে হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রকে আইনি সহায়তা দেন ব্যারিস্টার ওমর ফারুক। সোনালী ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাসুদ রেজা সোহবাহন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. খবিরুদ্দিন ভুঁইয়া।
রায়ের পর ব্যারিস্টার ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হরেন্দ্রনাথকে অহেতুক মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হয়েছে।
তিনযুগ ধরে তিনি এই মামলায় আইনি লড়েই করেছেন। সব শুনে সর্বোচ্চ আদালত তাঁকে মামলার খরচ বাবদ ২০ লক্ষ টাকা দিতে সোনালী ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন। তিন মাসের ভেতর এই টাকা দিতে বলা হয়েছে।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘গত বছর এই মামলাটি পরিচালনার জন্য সরকারি সংস্থা আইনগত সহায়তা কেন্দ্র (লিগ্যাল এইড) থেকে দায়িত্ব পাই।
পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২ নম্বর আদালতে মামলাটি শুনানির জন্য রাখা হয়। সেই সময় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি মামলাটি কার্যতালিকায় ওঠানোর নির্দেশ দেন। এর পর আপিল বিভাগের ২ নম্বর আদালত না বসায় মামলাটির শুনানি হয়নি।’
ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘ছাত্র-জনতারগণঅভ্যুত্থানের পর আপিল বিভাগ নতুন করে গঠিত হলে মামলাটি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নজরে আনা হয়। প্রধান বিচারপতি মামলাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় রাখার নির্দেশ দেন।
সে ধারাবাহিকতায় শুনানির পর রায় হলো।’
আইনজীবী মো. খবিরুদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, ‘আমি নোট পাঠিয়েছি। সোনালী বাংকের পক্ষ থেকে রায় পুনর্বিবেচনা করতে রভিউ আবেদন করা হবে।’
মামলা বিত্তান্ত
বিএ পাস করে ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক পদে সোনালী ব্যাংকে ঢাকার একটি শাখায় যোগ দেন হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র। তিন বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক হন। এর পর তাঁকে যাত্রাবাড়ী শাখায় বদলি করা হয়। ওই শাখা থেকে ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১শ টাকা আরেকটি শাখায় স্থানান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা সিল-স্বাক্ষরসহ লিখিতভাবে সমুদয় অর্থ বুঝে নেন। এর কিছুদিন পর ১৯৮৫ সালে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তহবিল তছরুপের অভিযোগে ১৯৮৫ সালের শেষের দিকে হরেন্দ্রসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে তাদের সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এরপর গ্রাহকের টাকা জমা না দেওয়ায় অপর একটি মামলায় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে স্থাপিত সামরিক আদালতের বিচারে হরেন্দ্রনাথের সাত বছর কারাদণ্ড হয়। পাশাপাশি অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে হরেন্দ্রনাথ জেল খেটে বের হন। এর আগে ১৯৮৫ সালের ২৯ জুলাই হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকার বিশেষ আদালতে ফৌজদারি মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। বিচারে ১৯৮৬ সালের ১৫ নভেম্বর বেকসুর খালাস পান হরেন্দ্রনাথসহ সবাই।
মামলায় হেরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গোপনে ১৯৮৮ সালে হরেন্দ্রসহ সবার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। সেই মামলায় এক তরফা রায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সমুদয় অর্থ ফেরত দেওয়ার আদেশ দেন আদালত। এর বিরুদ্ধে আবেদন (মিস কেস) করেন হরেন্দ্রনাথ। ১৯৯২ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালত আপিল গ্রহণ করেন; একই সঙ্গে বিচারিক আদালতের আদেশ বাতিল করেন।
এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে। ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট এ আপিল খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সেই আবেদন খারিজ করে রায় দিলেন সর্বোচ্চ আদালত।
২০১২ সালে হরেন্দ্রনাথ চাকরিকালীন বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা পেতে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। অর্থঋণ আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকার কারণে সেই রিটের নিষ্পত্তি হয়নি।